কুয়াকাটাতে এটাই প্রথম ভ্রমণ।
নিচে আমার ভ্রমণকাহিনী চেষ্টা করব বিস্তারিতভাবে ভাগ ভাগ করে তুলে ধরার। কষ্ট হলেও পড়বেন আশা করি।
#যাত্রা_শুরু:
গত ২৮ নভেম্বর রাতে কুষ্টিয়া থেকে নবীনবরণ বাসে আমরা ৪ বন্ধু যাত্রা শুরু করি।
বাস ভাড়া ছিল ৬৫০ টাকা। বাসটা একদমই ভাল না। পরে জেনেছি একই রুটে দিনাজপুর থেকে আরো দুটি ভাল বাস আছে তুহিন এবং গোল্ডেনলাইন।
তবে যারা ঢাকা থেকে আসবেন তাদের বাইরোড না আসাই ভাল। কারণ রাস্তা ভেঙেচুরে গেছে আর সময়ও লাগে বেশ। এক্ষেত্রে লঞ্চে আসতে পারেন, যদিও আমার অভিজ্ঞতা নেই এক্ষেত্রে।
শুনেছি ঢাকা থেকে হানিফ বাসের সার্ভিস চালু হয়েছে নতুন, সেক্ষেত্রে চেক করে দেখতে পারেন।
#চেক_ইন:
কুয়াকাটা পৌছাই সকাল ৭ টায়। আমরা আগে অনলাইনে হোটেল বুক করিনি। অফ সিজনে কুয়াকাটার হোটেলগুলো ফাকাই থাকে। তবে বাস থেকে নামার পরই প্রচুর ছোট ছোট বাচ্চারা (হোটেলের দালাল) ঘিরে ধরে। এটা খুবই খারাপ লেগেছে।
তবে ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে একটা ভ্যান নিয়ে জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিমে হোটেল সিন্ডেরেলায় যাই।
সেখানে কটেজ সিস্টেম রুম, আমরা ৪ জনের রুম পাই মাত্র ৭০০ টাকায়, সাথে এটাচ বাথ আর নীচে সুইমিংপুল। সব মিলিয়ে গ্রাম্য নিরিবিলি পরিবেশে অসাধারণ ছিল।
রুম ভাড়া কমাতে হলে ৪জন বা ৮জন এরকমভাবে যাবেন। দুজনের রুম অনেক হোটেলে নাই আর থাকলেও ভাড়া খুব বেশি। আর বেজোড় গেলে তো একজনের ভাড়া বেশিই দিতে হবে।
#ঘুরাঘুরি_শুরু:
আমরা দুটো বাইক ভাড়া করি ৬৫০ করে।
মোট ১১ টা স্পট ঘুরে দেখাবে সারাদিন। আপনারা অবশ্যই পুরো প্যাকেজের দাম একবারই ফুরোবেন নয়তো বিকালবেলা ঘুরিয়ে দেখিয়ে ভাড়া আরো বেশি চেয়ে বসবে।
আরেকটা বিষয় চেষ্টা করবেন যতদ্রুত সম্ভব বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরতে তাহলে দুপুরে সমুদ্রে গোসলের সময় বেশি পাবেন।
আমরা বাইকে উঠি সাড়ে দশটার দিকে। এসময় আমাদের টার্গেট ছিল বিচের পূর্বদিকের স্পটগুলো ঘুরে দেখা। বাইক আমাদের বিচ ধরে গঙ্গামতির চর, পুরাতন ঝাউবন, কাওয়ার চর, নতুন ঝাউবন ঘুরিয়ে দেখায়।
পথেই পরে লাল কাকড়ার চর তবে এখানে কাকড়া আসলে বেশি থাকে না। কাকড়া থাকে ঝাউবনের আরো পরে কাউয়ার চরের শেষ মাথায়।
সে এক অসাধারণ দৃশ্য, পুরো বিচ কাকড়ায় লাল হয়ে থাকে।
মূলত বিচ ধরে বাইক রাইডিংটাই বেশি ভাল লেগেছে। আর ঝাউবনে একটা ৩০ টাকা দামের ডাব খেয়েছিলাম যার স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনি!
এরপর যাই রাখাইন পল্লি, বৌদ্ধ মন্দির। আপনারা রাখাইন পল্লিতে শুধু চাদরটাই হাতে বানানো কিনতে পাবেন বাকিগুলা নাকি ঢাকা থেকে নিয়ে আসা!!
বাইক রাইডিং শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে আসি বিচে। এখানে পানিতে কিছুক্ষণ থেকে ফটোসেশন করে চলে যাই কটেজে।
একটা বিষয় জেনে রাখা ভাল। কুয়াকাটায় এসে কোনভাবেই কক্সবাজারের ঢেউয়ের আশা করবেন না। শীতের কুয়াকাটা খুবই শান্ত, একটা নদীর মতই।
#কুয়াকাটায়_বিকাল:
বিকালে বাইক এসে কটেজ থেকে আমাদের বিচের পশ্চিম দিকে নিয়ে যায়। ওদিকে আছে লেবুর চর, যেখান থেকে সূর্যাস্ত সবচেয়ে ভাল দেখা যায়। আরো দেখতে পাবেন তিন নদীর মোহনা।
তবে দুঃখের বিষয় কুয়াশার কারণে আমরা সূর্যাস্ত দেখতেই পারিনি!!
সূর্যাস্তের পর লেবুর চরে ফিরে আসি। এখানে মাছ, কাকড়া ফ্রাই বা বারবিকিউ পাওয়া যায়।
আমরা বড় সাইজের একটা টুনা মাছ আর চারটা কাকড়া ফ্রাই নেই মোট ৭০০ টাকায়।
দোকানদার অবশ্য ১১০০ চেয়েছিল, কাজেই দামাদামি করতে ভুলবেন না।
খাবারের টেস্ট বেশ ভালই লেগেছে। তবে বারবিকিউ সবাই নাও খেতে পারেন সেক্ষেত্রে ফ্রাই সবাই খেতে পারবেন আশা করি।
#কুয়াকাটায়দ্বিতীয়দিন:
কুয়াকাটা একদিনেই ঘুরে আসা সম্ভব। তবে কেউ চাইলে আরো একদিন থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ফাতরার বনও ঘুরে আসতে পারেন।
দ্বিতীয় দিন আমরা বোটে করে ফাতরার বন ঘুরতে যাই।
ফাতরার বন আর তার সাথে শুটকি পল্লি ও লাল কাকড়ার চর পারহেড ২৫০ টাকা করে।
টিকেট কাটতে হবে বীচের একটু পশ্চিম দিকেই কুয়াকাটা বোট মালিক সমিতির অফিস থেকে। সেখানে আরো কয়েকটা লম্বা দূরত্বের প্যাকেজ পাবেন, তবে ১২ জনের কম হলে সেগুলো কিনতে পারবেন না। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্যাকেজ হল কুয়াকাটা টু সোনার চর পারহেড ১০০০ করে।
প্রায় দেড় ঘন্টা পশ্চিমদিকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমরা পৌছাই ফাতরার বনে। এটা একটা ম্যানগ্রোভ অভয়ারণ্য দেখতে সুন্দরবনের মতই।
যদিও বেশি ভেতর পর্যন্ত ট্রেইল করা নেই তবুও প্রস্তুতি নিয়ে যেতে চাইলে যেতে পারেন। বেশি ভেতরে গেলে হয়তো চোখে পড়তে পারে বনবিড়াল। পেতে পারেন বন্য শুকর বা সাপের দেখা।
আর বোট রিজার্ভ করে নিলে সারাদিন ৩০০০ টাকা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক ভেতর পর্যন্ত খাল ধরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।
এরপর দেখলাম শুটকি পল্লি যেখানে শুটকি বানানো হয়, এক্কেবারে পানির দামে শুঁটকি পাবেন সেখানে।
ফাতরার বন ঘুরে আসতে আসতে বিকাল হয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় বিচে ঘুরাঘুরি করে জিরো পয়েন্টে কেনাকাটা করে ফিরে যাই কটেজে।
#ফিরে_আসা:
পরদিন দুপুরে ছিল আমাদের ফিরতি বাস গোল্ডেন লাইন ৭০০ টাক ভাড়া।
আমরা ১০ টার দিকে চেক আউট করে জিরো পয়েন্ট থেকে শুঁটকি কিনে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বাসে উঠি। এখানেও খুব ভালমানের সামুদ্রিক শুঁটকি পাবেন খুব অল্প দামে।
#কেমনখরচহবে?
কুয়াকাটায় সবকিছুই খুব কম দামে। সকালের নাস্তায় ৫ টাকায় রুটি আর ১০ টাকায় ভাল মানের সবজি পাওয়া যায়।
দুপুরে জিরো পয়েন্টের আশেপাশের দোকানগুলো থেকেই খাওয়া ভাল। দুরেরগুলো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এখানেও ১০০-১৫০ টাকার মাঝে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে পেট ভরে খেতে পারবেন।
আমাদের তিনদিনের ভ্রমণে মোট খরচ হয়েছিল প্রতিজন মাত্র ৩৩০০ টাকা।
খাওয়াদাওয়া সামলে খেলে আর বিকালের কাকড়া, বারবিকিউ না খেলে খরচ ২৫০০ এর মাঝেই হয়ে যেত মনে হয়।
কিছু তথ্য:
১/ বাটপার সব জায়গাতেই আছে। তবে ধোকা না খেয়ে চলতে পারাটাও কিন্তু স্মার্টনেসের পরিচায়ক।
২/ ফিরতি টিকেট বাস থেকে নেমেই করে ফেলা ভাল।
৩/ হোটেলগুলো দামাদামির উপরেই চলে। কাজেই দাম যেমনই চায় না কেন আপনার পছন্দমত একটা দাম বলতে দ্বিধা করবেন না।
৪/ মোটরসাইকেল ভাড়া করার সময় খুব সাবধানে ডিল করবেন, যেন কোন ফাঁকফোকর না থাকে। নয়তো পরে ভাড়া বেশি দাবি করে বসতে পারে।
৫/ চাইলে বারবিকিউ এর যোগাড়যন্ত্র করে নিজেরাও পার্টি করা যায়। কাছেই একটা বড় মাছের বাজার আছে যেখানে খুব অল্প দামে সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়।
৬/ দলবেঁধে গেল ফুটবল নিতে ভুলবেন না। বিচে সকালবেলা ফুটবল খেলতে বেশ ভাল লাগবে।
৭/ অফ সিজনেও শুক্র এবং শনিবার কুয়াকাটা বেশ জমজমাট থাকে। একারণে তখন হোটেলগুলোর ভাড়াও বেড়ে যায়।
ছবির স্থান : কাউয়ার চরের শেষ মাথা