একটি অতিপ্রাকৃত গল্প: অন্ধকার অতীতে অবগাহন..

images (13).jpeg


রশিদ সাহেবের মন আজ কিছুটা চঞ্চল। শুধু আজ নয়, গত কয়েকদিন ধরেই তিনি এক ধরনের মানসিক অস্থিরতার মধ্যে আছেন। তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না- তিনি কি ভুল দেখছেন, নাকি সত্যি তার সাথে এসব ঘটছে?

ইদানিং যখনই তিনি খুব ব্যস্ত থাকেন, মাঝে মাঝে এমন হয়- হঠাৎ করে তিনি একটা মুখ দেখতে পান। মুখটা খুব পরিচিত। অনেক দিনের চেনা মুখ। আসলে এটা তার নিজেরই মুখ। তবে এখনকার চুলপড়া, মেদ জমা, তেল চিটচিটে, নাদুস নুদুস চেহারা নয়। কলেজ লাইফের সেই হ্যাংলা-পাতলা, মেদহীন, প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী, ধারালো চাহনির ছেলেটার চেহারা।

যেমন আজ। অনেকদিন পরে তিনি লোকাল বাসে চড়েছিলেন। একটু তাড়া ছিল। কোন সিএনজি পাচ্ছেন না। অগত্যা বাধ্য হয়ে লোকাল বাসে উঠেছেন।

বাসে প্রচন্ড ভিড় ছিল। বসার কোন জায়গা ছিল না। ভিড়ের মধ্যে স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন- বাহিরে ফুটপাতে সেই চেহারাটা। মনে হল যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবং সেই চাহনি। যা দেখে একসময় ভার্সিটির শিক্ষকরা পর্যন্ত কেঁপে উঠতো। তার দিকে তাক করা সেই চাহনি। হঠাৎ মনে হল ছেলেটা যেন তাকে আশ্বস্ত করতে চোখের পলক ফেলল। গত কয়েক মাসে অনেক বার এধরনের ঘটনা তার সাথে ঘটেছে। এর কোনো ব্যাখ্যা তিনি খুঁজে পান নি।

প্রথমে ভেবেছিলেন এটা তার মনের ভুল। কিন্তু যখন বারবার একই ঘটনা ঘটছে, তখন তার সন্দেহ হলো। তাই তিনি আজ বাস থেকে দ্রুত নেমে পড়লেন। কিন্তু ভিড় ঠেলে নামতে নামতে ছেলেটাকে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে ফেললেন। এরপর ফুটপাথের ভিড়ে আতিপাতি করে খুঁজলেন। কোথাও ছেলেটাকে পাওয়া গেল না।

dangerous-chill-modern-design-contemporary-art-collage-trip-journey-vibes-big-pink-snake-crawling-mini-bus-tourists-car-144268316.jpg

তারপর থেকে কেন যেন রশিদ সাহেবের মনে এক ধরনের ভয় জেঁকে বসেছে। কেন তার অতীত চেহারা তার সামনে ফিরে আসছে? কি চায় সে? আসলেই কি সে তার অতীত? নাকি অন্য কেউ?

দ্বিধান্বিত মন নিয়ে রশিদ সাহেব একজন ভালো এবং অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট'র কাছে গেলেন। সাইকোলজিস্ট তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে তারপর সিজোফ্রেনিয়ার ওষুধ দিয়ে দিলেন। বললেন, এটা এক ধরনের হেলুসিনেশন। কিছুদিন রেস্ট নিলে আর নিয়মিত ওষুধ খেলে কেটে যাবে।

ওষুধগুলো খেয়ে এখন প্রচুর ঘুম আসে। কিছুটা দুর্বল লাগে। মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু সমস্যাটা কাটে না। এখনো নিয়মিত রশিদ সাহেব সেই মুখটা দেখতে পান। বরং ঔষধ খাওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে সেই মুখটা আগের চেয়ে আরো বেশি বেশি উঁকি দিচ্ছে!

একদিন সকালে বাজার করতে বের হলেন। বাজারের ভিড়ের মধ্যে যখন পটল নিয়ে দর কষাকষি করছিলেন, এমন সময় ডান পাশে তাকিয়ে মনে হলো- তিন কদম দূরে সেই মুখটাকে তিনি দেখতে পেলেন। নীল শার্ট পড়া সেই চেহারা। সেই চাহনি। রশিদ সাহেব ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে কাধেঁর মধ্যে হাত রাখলেন। না, এটা আরেকজন মানুষ। ছেলেটাকে দেখতে পেলেন দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু ভিড় ঠেলে তার ভারী শরীর নিয়ে ছেলেটাকে ধরতে পারলেন না।

images (20).jpeg

বাজার থেকে একবুক ক্লান্তি নিয়ে বাসায় আসলেন। এসে স্নান করে বারান্দায় আরামকেদারায় ঠেস দিয়ে বসলেন। ভাবতে শুরু করলেন অতীতের কথা। তার একটা মাত্র নীল শার্ট ছিলো। প্রচন্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাকে ছাত্রজীবন পার করতে হয়েছে। টিউশনি করে পড়ার খরচ জোগাড় করে চলেছেন। কত বেলা যে খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছেন- তার ইয়াত্তা নেই।

হঠাৎ তার স্ত্রী ডাক দিল, কি ব্যাপার সকালবেলা অসময়ে বারান্দায় বসে আছ? অফিসে যাবে না?

ডাক শুনে সম্বিৎ ফিরে পেলেন রশিদ সাহেব। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ব্রিফকেসটা হাতে নিয়ে বের হলেন। দেরি হয়ে গেছে আজকে একটা জরুরী মিটিং ছিল। রাস্তায় নামতেই স্লোগান শুনতে পেলেন। একটা মিছিল আসছে। সম্ভবত ধর্মঘট।

তার মনে পড়ে গেল- ছাত্রজীবনের তিনিও এরকম মিছিল-মিটিংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ছাত্র রাজনীতি করতেন। তবে সেটা সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি। তখন তিনি বিশ্বাস করতেন- রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করা যায়। এখন সেগুলোকে বোকা বোকা চিন্তা মনে হয়।

দেরি হয়ে যাচ্ছে। হন্তদন্ত হয়ে তিনি গাড়ি খুঁজতে লাগলেন। ধর্মঘটে যানবাহন খুব একটা বের হয় না। খুব অল্প কিছু সিএনজি রিস্ক নিয়ে রাস্তায় নামে। ফলে তারা বেশি ভাড়া আদায় করে। রশিদ সাহেবের জন্য ভাড়া কোন মেটার না। তার জরুরী অফিসে পৌঁছাতে হবে। মিটিংটা আর্জেন্ট। সময় বেশি নেই। একটা সিএনজি টেক্সী পেয়ে উঠে পড়লেন। কোন দরাদরি করলেন না।

উঠেই সিএনজি ড্রাইভারকে বললেন, তাড়াতাড়ি চালাও।

সিএনজির ড্রাইভার বলল, স্যার পরিস্থিতি ভালো ঠেকতেছে না। আজকে গ্যাঞ্জাম হইবার পারে।

রশিদ সাহেব বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তিনি ড্রাইভারকে বললেন, এক কাজ কর। ফুটপাত দিয়ে ধীরে ধীরে চালিয়ে যাও। তোমাকে ডাবল ভাড়া দেবো। আমার জরুরী কাজ আছে।

ডাবল ভাড়ার কথা শুনে ড্রাইভার লোভে পড়ে গেল। সে ফুটপাত দিয়ে দ্রুত গতিতে চালাতে শুরু করল। এবং একটা সময় তিনটি যুবককে দেখতে পেল সিএনজির সামনে। থামাতে বাধ্য হল।

images (19).jpeg

রশিদ সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবাক হয়ে দেখলেন- সেই ছেলে তিনটির মধ্যে নীল শার্ট পরা সেই চেহারাটাও আছে। এদিকে তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তিনি ভেতর থেকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন। তার আগেই নীল শার্ট পরা ছেলেটা সিএনজির ভেতরে কেরোসিন ঢালতে শুরু করলো। তার হাতে একটা দিয়াশলাইয়ের বাক্স।

সঙ্গে সঙ্গে রশিদ সাহেব আতঙ্কে নীল হয়ে গেলেন। তার মনে পড়ে গেল সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা। যে ঘটনা তিনি জীবনে ভুলবেন না। তার জীবনের একটা মস্ত বড় ভুল ছিল সেটি। তিনি ছিলেন পরিস্থিতির শিকার। তিনি শুধু একটু ভয় লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাটা যে একটা দুর্ঘটনায় মোড় নিবে, সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি। ঘটনাটা খুব দ্রুত ঘটে গিয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।

সেই ভার্সিটি লাইফের কথা। তাদের দলের ধর্মঘট ছিল সেদিন। তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন তিনিও। ধর্মঘট থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ রাস্তাঘাটে চলাচল করে। কেন করে?- সেই বয়সে সেটা বিরক্তির এবং রাগের কারণ ছিল রশিদের। এরকম একটা সিএনজিকে ফুটপাত দিয়ে তীব্রগতিতে যেতে দেখে তার বন্ধুদেরকে নিয়ে তারা সেদিন সিএনজিটা আটকে ছিল। তাদের ইচ্ছা ছিল শুধুমাত্র একটু ভয় দেখানো।

তরুণ বয়সের কাজগুলো সাধারণত দুঃসাহসিক হয়। রশিদ কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল সিএনজিতে। সে চেয়েছিল আগুন ধরার সাথে সাথে ভেতরের মানুষগুলোকে বের করে বুঝিয়ে দিবে- ধর্মঘটের দিন বের হওয়ার মজা। কিন্তু আগুন জ্বালানোর সাথে সাথে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। সেই অবস্থাতেই তারা দৌড় মাড়লো। পেছন থেকে জ্বলন্ত দুইজন মানুষের আর্তচিৎকার শোনা গিয়েছিল। সেই চিৎকার এখনও কানে বাজে।

images (18).jpeg

সিএনজির ভেতর বয়সে রশিদ সাহেব একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কে নীল হয়ে দেখতে পেলেন, সেই নীল শার্ট পরা পরিচিত মুখের ছেলেটা কেরোসিন ঢালছে সিএনজিতে। পেছনে পুলিশের গাড়ির শব্দ.. তবে কি তিনি নিজেকেই..

20200627_034755.jpg


আত্মকথনঃ

poster_1593196763985_rd7uzi0du0.gif

আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।



"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"


        জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি
H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now
Logo
Center