নব শালবন বিহার : গৌতম বৌদ্ধের বিশালতায়!

সূর্যের আলোয় সোনালি আভায় চিক চিক করা বিশাল বুদ্ধ মূর্তিটিকে অনেক দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়৷ হাজার বছর আগে কুমিল্লার এই অঞ্চলটা বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা ছিল। সময়ের বিবর্তনে তারা আজ আর নেই৷ কিন্তু তাদের স্মৃতি ধারন করা হাজার বছরের পুরানো প্রাচীন সব স্থাপত্য এখনো অস্তিত্বহীন হয় নি। ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও আজ হাজার বছর পর এসেও প্রাচীন সেই সব বৌদ্ধ অধিবাসীদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে সেগুলো। ধ্বংসপ্রাপ্ত সেসব স্থাপত্যের পাশে মাথা উচু করে যেন দাঁড়িয়ে আছে ওই বিখ্যাত নব বিহারটি৷

২০১৪ সালের দিকে প্রায় ৬ টন ওজন ও ৩০ ফুট লম্বা সুবিশাল মূর্তিটিকে এই বিহারে স্থাপন করা হয়। বন্ধুপ্রতিম দেশ থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ফাউন্ডেশন থেকে উপহার পাওয়া বিশেষ ধাতব পদার্থ থেকে এটি তৈরি করা হয়, যা এই বৌদ্ধ বিহারটির সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করেছে৷ বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসবের সময় দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অনেক অনুসারীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে এই বিহারটি৷ শুধু বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরাই না, এই বিহারটি দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেক পর্যটকও।

১৯৯৫ সালে নির্মিত হওয়া এই বৌদ্ধ বিহারটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শান্তি বিহার হিসেবেও পরিচিত৷ স্থাপত্যের দিক দিয়ে নান্দনিক ডিজাইনের এই বিহারটি সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ ক্ক্রতে সক্ষম। বান্দরবান ও কক্সবাজারের অসংখ্য বিহারে যাওয়া হয়েছে আমার। কিন্তু কুমিল্লার এই নব শালবন বিহারটি সেসব বিহারের চেয়ে কিছুটা হলেও আলাদা৷ সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এটি অবশ্যই অন্য সব বিহারগুলো থেকে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবে।

দেশের অন্য সব বিহারগুলোর সাথে এই বিহারের একটা পার্থক্য অবশ্য আছে। আর তা হল মেইন প্যাগোডা ভবনের তিন পাশে থাকা সিড়ির দুই পাশেই নাগ মূর্তি রয়েছে৷ যা আমি বান্দরবান বা কক্সবাজারের অন্য কোনো বিহার বা প্যাগোডায় দেখি নি৷ এখানে একটা কথা বলে রাখি৷ প্যাগোডা ও বিহারের মাঝে বেশ কিছু পার্থক্য আছে৷ প্যাগোডাকে শুধুমাত্র উপসনালয় বলা যায়, যেখানে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা ধর্মীয় রীতি নীতি পালন করে কিংবা উপাসনা করে। অন্যদিকে বিহারে ধর্মীয় উপাসনা তো হয়, পাশাপাশি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এসব স্থানে বসবাস করে। এখানেই তাদের ধ্যান, শিক্ষা সম্পন্ন করে।

বান্দরবান, রাঙামাটি কিংবা কক্সবাজারে বৌদ্ধ বিহার তেমন একটা দেখা যায় না শুধুমাত্র প্যাগোডা ছাড়া৷ কারণ ঐসব স্থানে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সংখ্যা বেশি৷ কিন্তু কুমিল্লায় এমনটা না। বৌদ্ধদের থাকা, খাওয়া ও বাসস্থানের জন্য তাই এরকম একটা বিহার তৈরি করা হয়েছে। যেন স্থানীয় যে কয়েকটা বৌদ্ধ পরিবার এখনো টিকে আছে, তারা যেন সুখে শান্তিতে ও নির্ভাবনায় বেঁচে থাকতে পারে৷

মেইন বিল্ডিং এর আশেপাশে বেশ কিছু কাঠের বাড়িঘর আছে বিহারের ভেতর৷ কোনোটি এক তলা, কোনোটি আবার দুই তলা। কাঠের তৈরি এই বাড়িঘরগুলো বাংলাদেশি ডিজাইনে বানানো হয় নি। মায়ানমার কিংবা থাইল্যান্ডের ডিজাইনে বানানো এই ছোট ছোট বাড়িগুলো দূর থেকে দেখতে বেশ সুন্দরই মনে হচ্ছিল। হুট করে কেউ দেখলে মনে করবে এই বুঝি বাইরের কোনো দেশে এসে পড়েছে৷

যায় হোক, একটা মজার কথা বলি। কুমিল্লায় আমি আজ প্রায় ১২ বছর ধরে বসবাস করি৷ এই নব শালবন বিহারের সামনে নিয়ে অসংখ্যবার যাওয়া আসা করলেও এর আগে কখনো বিহারের ভেতর ঢুকা হয় নি৷ আজ কী মনে করে যেন ঢুকেছিলাম। এন্ট্রি ফি ২০ টাকা করে। কিন্তু গায়ে লাগার মতো না৷ বিহারের ভেতর ঢুকার পর এর সৌন্দর্য দেখে মনটা ভাল হয়ে গিয়েছিল অনেক। এত সুন্দর একটা স্থানে এর আগে না আসায় আফসোসও হচ্ছিল৷ তার উপর আজ যেহেতু ওয়ার্কিং ডে, তাই মানুষ একেবারেই ছিল না বললে চলে। তাই খালি বিহারের সৌন্দর্য্যটাও ছিল দেখার মত৷

তবে আরো একটা সুন্দর জিনিস শেয়ার না করলেই না। আগেই বলেছি যে বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করে৷ প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে ছোট ভিক্ষুর সংখ্যাই বেশি৷ ছোট থেকেই এই বিহারে তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষাদান করা হয়৷ শিক্ষা শেষ হলে যে যার পরিবারের কাছে চলে যায়৷ তো আজ যখন বিহারের গেলাম, তখন দেখলাম যে এই সব ছোট ছোট ভিক্ষুদের নানা রকম কাজে ব্যাস্ত রাখা হয়েছে৷ কেউ গাছ লাগাচ্ছে, কেউ মাটি খুঁড়ছে, কেউ বা আবার পুরো মন্দির পরিষ্কার করছে৷ সপ্তাহে ১ দিন সম্ভবত এদেরকে দিয়ে এরকম কাজ করানো হয় যেন শরীর ও মন ভাল থাকে৷

যায় হোক, বেশ কিছুক্ষণ আমরা এই বিহারে ছিলাম৷ গৌতম বৌদ্ধের জীবনি ছোটবেলায় অনেকবার পড়া হয়েছে৷ বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে অল্প বয়সে যিনি মনের তাড়নায় নতুন এক জীবন গ্রহন করেছিলেন, সেটা ভাবতেও অবাক লাগে৷ এজন্যই হয়তো বৌদ্ধ এত বিশাল। আর তাই বৌদ্ধের এই বিশালতার কাছে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল।

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
2 Comments