পূণর্জন্মঃ জলপ্রপাতের নীচে সলিল সমাধি...

সেই সকালে দলিয়ান পাড়া থেকে রওনা দিয়ে সারাদিন মোটামুটি একটানা হেঁটে আমরা যখন গন্তব্যে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা!
সারারস্তা খুবই উপভোগ্য ছিল।
মাঝেমধ্যেই অসাধারণ কিছু জুম ঘরের দেখা পাওয়া, আকাশভায়ের কাওয়ালি গলায় গলা ছেড়ে গাওয়া গান, যেটা কিনা আশেপাশের পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হচ্ছে, আমাদের হাসি ঠাট্টা...
সারারাস্তা এভাবেই আনন্দে উল্লাসে এসেছি সবাই!

পাদটীকা- জুম ঘর পাহাড়ের গায়ে গায়ে জুম চাষা করে পাহাড়িরা। বেশীড়ভাগই হয় তাদের বাড়ীঘর থেকে অনেক দূরের পাহাড়ে। এজন্য তারা চাষের জমির আশেপাশে একচালা বাঁশের মাচান বানায়, ছনের ছাউনি দিয়ে। ওগুলাকে জুম ঘর বলে। পাহাড়ের ভেতর রাস্তা হারিয়ে ফেললে বা পাড়া খুঁজে না পেলে এই জুম ঘরই তখন রাত কাটানোর জন্য ভরষা!

QGWAEzsrfxdgfh.jpg
এই হচ্ছে জুম ঘর
আমাদের উদ্দেশ্য নাফাখুমের কাছে কোথাও আমরা আজকে ক্যাম্প করব ।
দলিয়ান পাড়া থেকে রেমাক্রি ফিরে যাওয়ার বহুল ব্যবহৃত রাস্তা ছেড়ে আমরা ভিন্ন পথ ধরেছিলাম।
নতুন রাস্তা আবিষ্কার করতে আমরা এই পথ বেছে নিয়েছিলাম।
আমরা কেউই নিশ্চিত ছিলাম না এই রাস্তা আমাদের কোথায় নেবে।
আদৌ কোনো পাড়ার দেখা মিলবে কিনা!

তখন শীতকাল! আর পাহাড়ি শীত মানে আরো কয়েকাঠি বেড়ে! রাত্তিরে এমন ঠাটিয়ে শীত নামে, মনে হয় বাংলাদেশে না, যেন আলাস্কায় আছি!

আমরা সবাই প্রপাতের আশেপাশে ইতস্ত ঘুরাঘুরি করে যারযার মত প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করছি। এমন সময় আমাদের চমকে দিয়ে ঝুপ করে সাইফ দেখি খুমে ঝাঁপ দিলো!

পাদটীকা- খুমঃ পাহাড়ি ঝর্ণা বা জলপ্রপাত গুলো নেমে এসে যে গভীর, খরস্রোতা এক কুয়োর মত জায়গায় পড়ে ওসব জায়গাগুলোকে খুম বলে। খুম যেমন সরু, তেমন গভীর। আর হাজার ফিট উপর থেকে তীব্র গতিতে বেয়ে আসা ঝর্ণা বা জলপ্রপাতগুলো বিভিন্ন জায়গায় এরকম খুম বানায়।

ওকে ইতস্ত সাঁতরে বেড়াতে দেখে আমারও লোভ লেগে উঠলো।
কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, শেষ সাঁতার কেটেছিলাম বোধহয় ১০/১২ বছর আগে তাও গ্রামের ছোট্ট পুকুরে! নাফাখুমের মত এই প্রপাতের খুমে এই ভরা সাঁজের বেলায় অই ঠুনকো মরচে পড়া স্কিল নিয়ে ঝাঁপ দেয়া মানে মরণকে কোলে নিতে চাওয়া!

কিন্তু সাইফকে সাঁতরাতে দেখে আমার মন আকুপাকু করতেই থাকে। আমি এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সাইফ খুম থেকে উঠেও গেলো!
আমি হতাশ হয়ে বললামঃ "আপনি উঠে গেলেন! ভেবেছিলাম আমি নামবো"
সাইফ সাথে সাথেই বললোঃ "তো নামেন! আসেন!"
এবার আকাশভাই আমাদের (punny)কাপলকে উস্কে দিয়ে বললেনঃ "হ্যাঁ! যান নামেন! দরকার হলে সাইফ নামবে আবার আপনার সাথে!”
তা শুনে সাকিব আর তারেকও সোৎসাহে হৈহৈ করে সমর্থন দেয়া শুরু করলোঃ "আরে আপু নামো নামো! জলদি নামো। সাইফভাই থাকতে ভয় কিসের!"
সাইফ বেচারা ওদিকে দাঁড়িয়ে ঠিঠি করে কাঁপতে কাঁপতে আমাকে তাড়া লাগালোঃ "আসলে এখনি আসতে হবে কিন্তু। কারণ পানির চাপ আস্তে আস্তে বাড়ছে!
(যেহেতু চাঁদ ওঠা শুরু করেছে)"

GQARWESFG.jpg
এই আমাদের যাযাবর ঘর
কিন্তু সত্যি বলতে যেই তীব্র গর্জনে খুমে জলপ্রপাত আছড়ে পড়ছে, এটা দেখেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু এডভ্যাঞ্চারের খুব লোভও হচ্ছে!
সাইফ অলরেডি আবার ঝাঁপ দিয়েছে আবার!
তো সেই একযুগ আগের অভিজ্ঞতা আর অবশ্যই সাইফের ভরষায় আর কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই ঝাঁপ দিলাম নাফাখুম জলপ্রপাতে!!!

মানে আমি যে আর সিনেমার নায়িকা না তাতো আমি মেনেই নিয়েছি!
তবুও ভেবেছিলাম একটু আকর্ষনীয় স্টাইলে নায়িকারা যেভাবে পুলে ঝাঁপ দেয় সেভাবে একটা ঝাঁপ দেবো!
আমার আকাঙ্ক্ষায় ঝাঁটার বাড়ি!
লাফটা দিলাম কোলা ব্যাঙের মতো!
খুমে পড়তেই টুপ করে মাটির কলসির মত তলিয়ে গেলাম!

তায় যোগ হয়েছে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা পানি।
গেলাম ভয় পেয়ে। এবার ভয় যখন মনে ঢুকে গেলো, সাঁতারের সব তত্ত্ব, তথ্য ভুলে গেলাম নিমিষেই! হাঁচড়ে পাঁচড়ে কোনোমতে ভেসে উঠলাম!
উঠে যেন আরো বিপদ!
আমি একদিকে যেতে চাই, ঝর্ণার স্রোত আমাকে আরেকদিকে নিয়ে যায়!
photo_2022-04-10_00-14-49.jpg
জলপ্রপাতের সোজা যে ধারাটা নেমে আসছে তার পিছনে নাকি দাঁড়ানোর মত একটা জায়গা আছে সাইফ বলছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে নাকি দেখা যাবে চোখের সামনে গর্জন করে প্রপাতের খুমে নেমে যাওয়ার অপার্থিব দৃশ্য।
সাইফ নামার আগেই বলেছিলো, আমাদের গন্তব্য ওখানে। আমার এই যুদ্ধের মাঝে সাইফ ওখানে পৌঁছেও যায়।
ডুবে ভেসে কোনোমতে ওখানে পৌঁছলাম!

পৌঁছে এবার খুম থেকে ঝর্নার পিছনে ওই ছোট্ট গুহার মত জায়গায় ওঠাটা হলো আরেক যন্ত্রণার।
প্রপাতের ধারার কাছে যাওয়া যাবেনা। তা না হলে পানির স্রোত সোজা খুমের তলায় চেপে ধরে কবর দিয়ে দিবে। আবার ওখানে উঠতে হলে জলপ্রপাতের মূল ধারার কাছে না যেয়েও উপায় নেই।

যাহোক, কায়দা করে উঠতে সক্ষম হলাম।

পিচ্ছিল, শ্যাওলা ধরা বড়জোর ৩ফুট প্রস্থের একটা ছোট্ট গুহা গুহাও না, একটা খাঁজের মত, এতই ছোট্ট।
আমি আর সাইফ কোনোমতে দাঁড়িয়েছি। তাতেই নড়াচড়ার জায়গা শেষ। কোনোমতে দুইপা রেখে কুঁজো হয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে।
শুরুতেই পানির চাপের সাথে যুদ্ধ করে কিঞ্চিৎ ভয় ঢুকে গেছে মনে।
নিজেকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করছি।
এখানে এসে যদি ভয় পেয়ে যাই, আর ফিরতে পারবোনা।
আর ফিরতে না পারা মানে স্রেফ মৃত্যু! সাহায্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

আমি উঠে জলপ্রপাতের দিকে পিঠ দিয়ে গুহার দেয়ালের দিকে মুখ করে, খাঁজ ধরে দাঁড়িয়ে দম নেবার চেষ্টা করছিলাম।
সাইফ চিৎকার করে বারবার আমাকে প্রপাতের দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়াতে বলছে! যে সৌন্দর্য্য দেখাতে নিয়ে এসেছে।
কোনোমতে দম একটা নিয়ে ঘুরে তাকালাম!

স্রেফ কয়েক সেকেন্ড ঘুরে তাকাতে পেরেছিলাম বোধহয় প্রপাতের দিকে। ঐ মুহুর্তে মনে হলো এই অপার্থিব, এই বন্য ভয়ংকরতা, এই সৌন্দর্য্য… এইটা দেখার পর জীবনে আর কোনো অপ্রাপ্তি থাকা সম্ভব না।

ঠিক চোখের কয়েক ইঞ্চি সামনে দিয়ে প্রচন্ড গর্জনে, পানির সাদা পর্দা নাফাখুম জলপ্রপাত নেমে যাচ্ছে নিচের খুমে। সে গর্জন এত প্রচন্ড যে সাইফ মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে চিৎকার করলেও আমি সেটা শুনতে পাচ্ছিনা।
চোখের পাতায় যে পানির ছটা লাগছে, এগুলার চাপ এমন যে মুখ সরিয়ে আনতে হচ্ছে!
অল্প একটু ঘুরেই একহাত বাড়িয়ে দিলাম এবং পরক্ষণেই মনে হলো আমার হার্টবিট দেড়শ পেরিয়ে গেছে একলাফে!
কারণ প্রপাত এত তীব্র গতিতে নেমে আসছে যে মনে হলো সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরি হলেই হয় আমার হাত খুলে চলে যেত অথবা আমিই পড়ে যেতাম, এত প্রচন্ড ভয়াবহ চাপ!

ঝট করে আবারও দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে উল্টো ঘুরে গেলাম খাঁজের দেয়ালের দিকে!
হঠাৎ করেই আমার প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট শুরু হলো। যত কায়দা কসরতই করি না কেনো, শ্বাস নিতে পারছিনা। একদমই নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা, রিতীমত ফুঁপিয়ে কান্নার মত করে হেঁচকি তুলছি নিঃশ্বাস নিতে না পেরে।
চোখ জ্বলছে, শরীর অবশ লাগছে আচমকা অক্সিজেনের অভাবে।

এটা দেখে সাইফ আর দেরি না করে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল।
জিজ্ঞেস করলো যেদিক দিয়ে এসেছি ওদিক দিয়েই যাব না উল্টা দিক দিয়ে বেরুবো।
আমি উল্টা দিক দিয়ে বেরুনোর সায় দিলাম যদিও, কিন্তু আতঙ্কে, শ্বাসকষ্টে আর ঠান্ডায় আমি যেন জমেই গেলাম।
চিন্তা ভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে সব!

সাইফ তাড়া দিচ্ছে জলদি করতে নইলে পানি বেড়ে যাচ্ছে খুমের! দেরি করলে পরে আর ফিরতেই পারবোনা!
আমি দম নিয়ে মাথা ঝাঁকাতেই সাইফ লাফ দিল খুমে।
কিন্তু আমি যেন কিছুতেই পা জোড়াকে নড়াতে পারছিনা। ওখানে দাড়িয়ে প্রচন্ড হাঁপাচ্ছি!
আতঙ্ক জেঁকে ধরছে সব মিলিয়ে। সাইফকে সাঁতরে চলে যেতে দেখে অনেকটা আতঙ্কেই লাফ দিলাম।

এবং তাড়াহুড়োয় হিসেব না করে একদম ভুল জায়গায় লাফটা দিলাম।
অর্থাৎ জলপ্রপাতের ধারা বরাবর, খুমের ঠিক মাঝখানে।
আর যাই কোথা!
প্রপাত এসে সোজা চেপে ধরলো।
আমি যতই হাঁচড়ে পাঁচড়ে উপরে উঠতে চাই, পানি আবার আমাকে চেপে ধরে।
সব ভয়, আতঙ্কের সাথে সারা দিনের হাঁটার ক্লান্তি, না খাওয়ার সাথে যোগ হয়েছে জলপ্রপাতের পানির চাপ।
চেষ্টা করছি মাথা ঠান্ডা রেখে সাঁতরে উপরে উঠতে।
কিন্তু এরকম ব্যর্থ হাত পা ছুঁড়ে উল্টো অবশ হয়ে আসছে হাত পা।
এরকম ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিতেই নাকে মুখে পানি খেতে খেতে ডুবতে শুরু করলাম!
আর তখনই পানির ঝাঁঝের কারণে ঝটকা দিতেই, সম্বিত ফিরতেই আরেকবার উঠার চেষ্টা করতেই দেখি সাইফ হাত নাড়িয়ে হাত ধরতে বলছে।
হয়তোবা এক হাত মত দুরত্বে সাইফ। অইটুকু পৌঁছতেই যেনো আমার লেগে গেলো অনন্তকাল।
বাড়ানো হাতটা খপ করে ধরলাম অবশেষে।
ও টান একটা দিতেই আমি নরক থেকে খানিকটা বেরিয়ে এলাম।
দুজনে প্রাণপণে সাঁতরে অনন্তকাল পর অবশেষে একটা পাথরের খাঁজ খুঁজে পেলাম।
ওটাতে আঙুল ঠেকিয়ে কোনোমতে ঝুলে একটু দম নিলাম। সাইফের দেখিয়ে দেয়া জায়গায় আস্তে আস্তে ওঠে এলাম।
element.png
খুম থেকে ওঠে আসার পর হতবিহবল দুই প্রাণী

বাকি তিনজনের কেউই টেরই পায়নি যে, এমন ভয়ংকর ঘটনা হয়ে গেছে খুমের ভেতর।
আমাদের উঠে আসতেই স্বাভাবিক রসিকতায় আকাশ ভাই আমাদের উদ্দ্যেশ্যে গান ধরলেন!

আর আমরা দুই হতবিহবল প্রাণী পাথরের উপর বসে একবার একে অন্যের দিকে তাকাই, একবার জলপ্রপাতের দিকে তাকাই। তারপর উন্মাদের মত হাহা করে হাসতে থাকি!

শীতের রাত নামছে।
পাহাড়ি শীত।
আর এদিকে বরফ ঠান্ডা পানি থেকে উঠে এসে সেই ভেজা কাপড়েই আমরা পাশাপাশি বসে রইলাম বহুক্ষণ।
ঠিঠি করে কাঁপছি দুজনেই।
সাইফ তাড়া দিল উপরে উঠে, তাঁবুতে যেয়ে কাপড় পালটে নিতে।
আমার মনে হলো এই মুহুর্তে সবকিছু স্থবির হয়ে গেছে।
প্রচন্ড ক্লান্তি শ্রান্তিতে সাইফের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বললাম “আর একটুক্ষণ থাকি”

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now