টিউশনিতে যাবো এমন সময়ে মা ডাকলো...
বাবা হৃদয়!একটু এদিকে আসবি?
শার্টের হাতটা মোড়াতে মোড়াতে মায়ের কাছে গেলাম,
-হ্যা মা বলো,ডেকেছিলে তুমি?
গিয়ে দেখি মা আগে থেকেই আমার সাথে কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে,
-বাবা তোকে কিভাবে যে বলবো কথাটা!(সংকোচ মুখে)
মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-মা,কিছু কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?
-তুই তো জানিস বাবা মাস তো শেষ হয়ে যাওয়ার পথে,উপরন্তু সব জিনিষপত্র প্রায় শেষ,,বাড়িতে রান্না করে খাবার মতো তেমন কিছু ই নেই,মা হয়ে তোকে কথাটা বলতেও লজ্জা লাগছে বাবা...''তোর কাছে কি কিছু টাকা হবে?আমি তাহলে বাজার করে নিয়ে আসতাম
-ছি! মা এভাবে বলছো কেন??আমার কাছে তো টাকা আছেই,আর জিনিসপাতি শেষ হয়েছে আমাকে আগে বলোনি কেন??
-আমি তো তোকে সারাদিন দেখি, কত ধকল তোর উপর দিয়ে বয়ে যায়.....তোকে সারাদিন এভাবে কস্ট করতে দেখলে অনেক খারাপ লাগে,তাই তোকে আর বলা হয়ে উঠেনি বাবা,
(নরম কন্ঠে),তুমি ও না মা!)
কে বলেছে আমার উপর দিয়ে ধকল যায়....?আর হ্যা..কি কি জিনিসপাতি বাজার করে আনতে হবে আমাকে বলো~~ আমি থাকতে তোমাকে বাজারে যেতে হবেনা,...টিউশনি তে যাবার আগেই বাজার টা করে দিয়ে যাচ্ছি.....যাও বাজারের ব্যাগটা নিয়ে এসো
মা ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে......কি হলো মা যাও;ব্যাগটা নিয়ে আসো গিয়ে।
ব্যাগটা এনে আমার হাতে দিয়ে মা আবারো বললো,''বাবা তোর কাছে টাকা আছে তো??''
মা..তুমি এতো ভাবছো কেন??আমার কাছে টাকা আছে তুমি একদম টেনশন করোনা ~
কথাটা বলে বাজারে যাবো এমন সময় মা পিছন থেকে কি যেন মনে করে আবার ডাকলো....
-হ্যা মা আর কিছু বলবে??...বাজারের জিনিসে আরও কিছু লাগবে??
-না বাবা,তোর গায়ের শার্ট টাতো অনেকদিন হলো দেখছি পড়ছিস, এই পুরাতন আধ ময়লা শার্টটা আর কতো দিন পড়বি?~আমারো তো বাবা বয়স হয়েছে,মহিলা মানুষ আমি ~~উপার্জন করার সামর্থ্য শক্তি নেই,থাকলে আমার ছেলেটার জন্যে এতদিনে একটা শার্ট ঠিক কিনে দিতাম....
তুই সারাদিন বাইরে বাইরে এদিক ওদিক যাস, টিউশনি করিস, চারপাশের লোকজন প্রতিবেশী রা তোকে নিয়ে কত কি বলে...আমি শুধু আড়ালে আড়ালে তোর প্রতিদিন এক শার্ট পরে যাওয়া নিয়ে প্রতিবেশীদের কটাক্ষ করে বলা সেই কথাগুলো নীরবে শুনে যাই রে বাবা,...
আমি শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে মায়ের কথাগুলো শুনছিলাম
একটু পর মা আবার বললো...''জানিস হৃদয় তোর বাবা কিংবা তোর বড়/ছোট ভাইদের যে কেউ বেচে থাকলে হয়তো আজ আমাদের এরকম পরিস্থিতিনির্ভর হতে হতোনা,এসবই আমাদের দূর্ভাগ্য রে বাবা,....
মা কে আর কথা বাড়াতে দিলামনা...
মা ছাড়োনা এসব কথা, যা হবার তাতো হয়ে গেছে, হয়তো আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের ভাগ্যে এটাই লিখে রেখেছিলেন. ..পূরনো কথা আর টেনোনা...বাবা -ভাইয়েরা নেই তো কি হয়েছে??...তুমি- আমি আছিতো....
আমি জানি অতিত ভুলা সম্ভব না, তাও আমরা মা ছেলে দুজন মিলে অতিত কে ভুলে আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎটাকে ভালো করার চেস্টা করবো...
শুধু আমাকে ভালো করে পরিক্ষাটা দিতে দাও; আমার ভালো একটা পজিশনে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করো;আর নামাজ পরে দোয়া করো মা... .তারপর দেখো আমি তোমার সব আফসোস.... তোমার সব দূঃখ ঘুচে দিবো.......তোমার সব ইচ্ছে পূরন করবো....
তাই যেন হয় বাবা,(মা)
আর আমি শার্টের ব্যাপারটা মাথায় রাখবো কেমন??
-ঠিক আছে।
হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে.....
এই দেখ তোমার সাথে এগুলা নিয়ে কথা বলতে বলতে আমার দেরি হয়ে গেল....তুমি তো জানোই সাদিকের গার্জিয়ান (যাদের বাসায় পড়ায়)কেমন??একটু লেট করলেই খিটখিট করে কথা শুনায়...তুমি বরং এখন দরজাটা লাগিয়ে দাও,আমি চটজলদি বাজারটা তোমাকে করে দিয়ে যাচ্ছি।
মা আর কিছু না বলে দরজাটা লাগিয়ে দিলো।
বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা গাছের নিচে থেমে প্যান্টের পিছনের ২টা পকেট হাতাতে লাগলাম।হাতানোর পর ডানপাশের পকেট থেকে ভাজ করা একটা পাঁচশো টাকার আর দুইটা একশো টাকার নোট বের হলো। এইতো ২দিন আগেও ঠিক মত চলার মতন টাকা ছিলনা তাই বন্ধু আবিরের কাছ থেকে টাকাগুলো ধার নিয়েছিলাম টিউশনির টাকা পেয়ে শোধ করে দিবো বলে.....মাকে যদি বলতাম ধারের টাকায় চলছি তাহলে হয়তোবা আর কখনো ''বাড়ির জন্যে কিছু লাগবে ''কথাটা মুখ দিয়ে বলতনা...বাবা অক্কাপ্রাপ্তির পূর্বে ভাগ্যিস বাড়িটা রেখে গেছে নইলে মাকে নিয়ে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হলো আর বাড়ি ভাড়া??সে তো এক আলাদা খরচ....
কোঁকড়ানো দুইটা নোটের দিকে খানিকক্ষন চেয়ে থেকে এগুলাই চিন্তা করলাম কিছুক্ষন....তারপর টাকাগুলো আবার ভাজ করে পকেটে রেখে বাজারের দিকে রওনা হলাম,বাজার করে বাড়িতে দিয়ে চলে আসলাম টিউশনিতে....
যাদের বাসায় পড়াই তাদের বাড়ি একটু দূরে অবস্থিত , তাই বাসে করে যেতে হয়।
মেইনরোডে বাসস্টপে এসে বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।সাদিকদের বাসায় এখান থেকে রিক্সাতেও যাওয়া যায় কিন্তু বাসে গেলে রিক্সা ভাড়ার এক-পঞ্চমাংশ টাকা লাগবে,আর আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমাদের পকেটে সব সময় টাকা থাকেনা তার উপর আমার আবার ধারের টাকা।তাই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়।
দোতালা বি.আর.টি.সি. বাসটা আমার সামনে এসে দাড়ালো।বাসস্টপে দাঁড়ানো লোকগুলো হুমড়ি খেতে খেতে বাসে উঠছিল আমিও ঠেলে, চিপাচিপি করে কোনো এক রকমভাবে উঠে পরলাম।নিচতলায় বসার মতো কোনো সিট নেই।উপরের তলায় হয়তো আছে এই ভেবে উপরে উঠলাম।শেষ এর দিকে জানালার ধারের একটা সিট ফাকা ছিলো।সেখানে গিয়ে চট করে বসে পড়লাম নইলে অন্য কেউ বসে পড়ত আর সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে থেকে ঘামতে ঘামতে যেতে হতো।
বাস চলতে শুরু করলো আমিও সিটটাতে বসে জানালার দিকে মুখ করে বাহিরে আশে পাশের অবস্থা দেখছিলাম~ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন আমার শার্টে এক টান দিলো।মুখটা ঘুরিয়ে দেখলাম,কালো ফ্যাকাশে চিকন একটা ছেলে বড়জোর ৪-৫বছর হবে,খালি পায়ে,পরনে ময়লা হ্যাফপ্যান্ট ;একটা ছেড়াফাটা গেঞ্জি,কাধে ঝুলানো পলিথিনটা থেকে এক প্যাকেট পপর্কন বের করে আমাকে বলছে।