আমরা তখন যশোরে থাকতাম।
একেবারেই ছোট। স্কুলেও ভর্তি হইনি।
আব্বু যশোর সদর হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন সেসময়।
শহরের সবচেয়ে ভাল স্কুল হিসেবে খ্যাত ছিল সেক্রেট হার্ট জুনিয়র হাই স্কুল।
ইংরেজী মাধ্যমের এই স্কুলেই আমার প্রথম পড়ালেখার শুরু।
ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে আমাদের বাসার পরীক্ষা প্রস্তুতি পর্বটা ছিল এমন..
বড় ভাই ভর্তি হবে কেজিতে।
অতএব আমাকে নার্সারিতে হতেই হবে।
বড় ভাইকে যা করানো হত, আমাকে তার এক ধাপ নিচের কিছু করাতে হবেই।
যদিও তখন আমাকে প্লে তে ভর্তি করলে ঠিক হত। কিন্তু ভাই যেহেতু কেজিতে কাজেই আমাকে নার্সারীতেই ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে।
সেসময় ঐ স্কুলে অবশ্য প্লে ছিলও না।
যাহোক, আম্মু আমাদের দু'ভাই বোনকে টেবিলের দু'পাশে নিয়ে পড়তে বসালেন।
আমার ভাই খুব জেদী টাইপ ছিল।
যেকোন কারণেই হোক সে আর পড়বে না।
কিন্তু আমার আম্মু পড়া শেষ না করে উঠতেও দিবেন না। তাই আম্মু তাল পাখা উল্টা করে নিয়ে ভাইয়ুকে আস্তে আস্তে একটা করে বাড়ি দিতে লাগলেন আর আমার ভাই তখন একটু করে পড়ে।
আর আমি আম্মুর হাতে পাখা দেখে আগেই
নিজেকে ভাল প্রমানের জন্য বেশী করে জোরে জোরে পড়তে লাগলাম।
এভাবে পুরো পড়া শেষ করিয়ে আমাদের স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করিয়েছিলেন আম্মু।
আমরা দু'ভাই বোনই কৃতিত্বের সাথে চান্স পেয়েছিলাম।
বিশাল বড় স্কুল, বিশাল বড় গেট..
আমাকে যখন ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে আম্মু গেটের বাইরে চলে গেলেন এবং বিশাল গেটটা বন্ধ হয়ে গেল, তখন আমার সেকি কান্না !
আমি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম, আমার মনে হচ্ছিল আমি আর কোনদিন আম্মুকে দেখতে পাবনা।
আমাকে সামলাবার জন্য একজন সিস্টার এগিয়ে আসলেন। ওখানকার টিচারদের সিস্টার বলে ডাকতে হত।
একটা চকলেটের বক্স আমার সামনে ধরে বললেন,নাও চকলেট নাও। কেঁদো না।
আমি হঠাৎ সামনে চকলেটের বক্স দেখে খুশী হয়ে গেলাম। কান্না থামিয়ে মুঠো ভর্তি করে চকলেট নিলাম।
এবং আবার কান্না শুরু করলাম।
সিস্টার বললেন, কাঁদছো কেন আবার ? ফোঁপাতে ফোপাতে বললাম, আমার ভাই কেজিতে পড়ে, আমি তার জন্যেও চকলেট নিবো।
সিস্টার হেসে ফেললেন আমার কান্ড দেখে।
বললেন,নাও তোমার ভাই এর জন্যেও চকলেট নাও কিন্তু কেঁদো না।
আমি মহাআনন্দে আরো এক মুঠো চকলেট নিয়ে পকেটে ভরে ফেললাম।
স্কুল ছুটির পর বড় ভাইকে পেয়ে আপন জন ফিরে পাওয়ার আনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরে আগে একপ্রস্হ কেঁদে নিলাম।
তারপর পকেট থেকে চকলেট বের করে তাকে দিলাম। জীবনে প্রথম আমি বড় ভাইকে নিজের যোগ্যতায় কিছু দিয়ে মুগ্ধ করতে পেরে ভাবেই অস্হির !
স্কুল জীবনের প্রথম দিনটা দারুণ চকলেট-ময় ছিল আমার !!
তবে স্কুলে গিয়ে আমি প্রতিদিনই কাঁদতাম আম্মুর জন্য।
আম্মুর শাড়ীর আঁচল ধরে থাকতাম,কিছুতেই ছাড়তে চাইতাম না।
আর সিস্টার রা আমাকে চকলেট দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার কান্না থামাত ।।
এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় স্কুল ছিল।
পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছিলাম এই স্কুলে।
পরবর্তীতে আব্বুর বদলী জনিত কারণে আমার স্কুল জীবন কেটেছে বিভিন্ন জেলা শহরের গভঃ গার্লস হাই স্কুলগুলোতে।