দুই বাসের ফাঁকে আটকে পড়েছে কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের ডান হাত। বাসের চাপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে হাতটি। প্রথম আলোয় প্রকাশিত রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার মোড়ের ছবিটি নিশ্চয়ই আপনারা দেখেছেন। দেখে নিশ্চয়ই চমকে গেছেন। কেউ কেউ নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়ে গেছেন। আচ্ছা আমাদের পুরো রাষ্ট্র সমাজ কী অসুস্থ হয়ে পড়ছি না?
কেউ কেউ উন্নয়ন নিয়ে এখন বিতর্ক তুলতে পারেন। নানা সংকটের পরেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। গবেষনা উপস্থাপনের মতো কলাম লিখে সেই উন্নয়নকে অস্বীকার করার কোন প্রবনতা আমার নেই। কিন্তু আমি সবসময় বারবার যে কথাটি বলার চেষ্টা করছি মানবিক মূল্যবোধগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। অসুস্থতার দিকে ধাবিত হচ্ছি আমরা। কী নারী নিপীড়ন, কী গণপরিবহনম, কী স্বাস্থ্যব্যাবস্থা কী শিক্ষা ব্যবস্থা সব ক্ষেত্রেই একই অবস্থা।
মনে আছে ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর মারা যাওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আমরা অনেকদিন রাজপথে ছিলাম। আজকে আপনারা দেখছেন দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারিয়েছে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। আদালত ইতিমধ্যেই তাঁর চিকিৎসা ব্যয় ওই দুই বাস মালিককে বহন করতে নির্দেশ দিয়েছে।
কিন্তু দিনের পর দিন তো ঢাকায় এভাবেই বাসের প্রতিযোগিতা চলছে। আমাদের পুলিশ প্রশাসন সবার সামনেই এই অবস্থা চলছে। আমাদের ঢাকাশহরের বাসগুলোর অবস্থা দেখেন। রোজ যারা এই বাসে চড়েন তারা জানেন জীবন কতোটা যন্ত্রণার।
আজ রাজিবের হাত গেছে কাল আপনার আমার জীবন যাবে। কিন্তু অপরাধটা কী আমাদের? রাজীবের কথাই ভাবুন। মা-বাবা নেই। টিউশনি করে সবার সহযোগিতায় পড়াশোনা করছিলেন।
বড়লোকদের মতো গাড়ি নেই। তাই বাসে চড়েন। হাতটা বেরিয়েছিল সামান্য বাইরে। আর দুই বাসের প্রবল চাপে সেই হাতটাই গেল। কতোটা অসভ্য বর্বর শহরে আমরা থাকি যে শহরের রাজপথে হাত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এক যুবক গোঙায়। আমরা সেই ছবি তুলি।
আগেই বলেছি ঢাকা শহরের বাসগেুলো যেভাবে চলে, যে মানের বাস, যেভাবে তারা যাত্রী তুলে সেগুলো কোন সভ্য শহরের ছবি নয়। শুধু বাস কেন আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থার যে ভয়াবহ চিত্র সেটা কী আমাদের নীতিনির্ধারকদের চোখে পড়ে? পড়লে দিনকে দিন কী
পরিস্থিতি এতো খারাপ হতো? কোথাও কোন অফিস নে, জনবল নেই, পুলিশ নেই অথচ উবার পাঠাও তাদের হাজার হাজার গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আর আমাদের রাষ্ট্র হাজার হাজার পুলিশ বিআরটিএ নিয়ে সিএনজিগুলোকে মিটারে চালাতে পারে না। বাসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অথচ বড় বড় কথা বলার সময় এরা ইউরোপ আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যায়।
আমাদের কী বাজেট কম? বাংলাদেশের সড়ক ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তো এতো হাজার হাজার কোটি টাকার সুফল কবে পাবে জাতি? কেন ঢাকার বাইরে থাকা আসা হাজার হাজার তরুণ আগেরাতে রওয়ানা দিয়েও ঢাকায় পৌঁছাতে পারে না যানজটের কারণে? কেন দিনকে দিন ঢাকা অচল হয়ে পড়ছে? আমি জানি এসব কথা বললে আমাদের নীতি নির্ধারকরা মেলা বেজার হন।
অবশ্য হবেনই বা না কেন? একটু চিন্তা করলেই দেখবেন সব জায়গায় আমাদের ক্ষমতাশালীরা একটা বিকল্প ব্যবস্থা করে নিয়েছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট। সমস্যা কী তাতে? আমাদের রাজনীতিবিদ মন্ত্রী সচিব বা বড় বড় ব্যবসায়ীদের ছেলেমেয়ে তো বিদেশে পড়ছে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা। সমস্যা কী? তারা তো বিদেশে চিকিৎসা করাবে। দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা ধ্বংস সমস্যা কী তারা তো ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়েন।
এই যে সব ক্ষেত্রে একটা বিকল্প ব্যবস্থা, বিকল্প সমাজ করে করে আমরা নিজেদের নিরাপদ ভাবছি। কিন্তু আদৌ কী তাই? একদিন কী এর প্রভাব পুরো রাষ্ট্র সমাজে পড়বে না? জনগন যেখানে যায় সেই ব্যবস্থাগুলো আর কবে ভালো হবে? আমি বলছি কোনদিন হবে না।
আমি বলছি লিখে রাখেন, আমাদের প্রভাবশালীরা যতোদিন সরকারি হাসপাতালে না যাবেন সরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র বদলাবে না। যতোদিন তাদের ছেলেমেয়েরা সরকারি প্রাইমারিতে না যাবে ততোদিন সেগুলো ভালো হবে না। যতোদিন তারা বাসে না চড়বে কোনদিন বাসগুলো ভালো হবে না। আর যেদিন তারা নিজ নিজ গাড়িতে ছেড়ে গণপরিবহনে করে এই শহরে চলবেন, অফিস আদালত করবেন সেদিনই পরিস্থিতি বদলাবে। নতুবা নয়।
আর আপনারা প্রভাবশালী বড়লোকরা যারা ভাবছেন সব জায়গায় আপনাদের বিকল্প আছে তাদের বলি আপনারা এখন কোটি টাকা দামের গাড়ি থাকতে পারে। কিন্তু সেই গাড়িতেও ঢাকা শহরে ঘণ্টার পর ঘন্টা যানজটে বসে থাকতে হবে। ফার্মগেট থেকে শাহবাগ যেতেই আপনার এক ঘন্টা লাগবে। এই যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব ব্যবস্থা নষ্ট হচ্ছে এর প্রভাবও আপনারা একদিন পাবেন। এই দেশের কোটি তরুণ যে হতাশায় ডুবছে তার পরিনতিও পাবেন।
এখনো বলি দি সমাধান চান সার্বিক ব্যবস্থাপনাগুলো ঠিক করুন। দেশটাকে রক্ষা করুন। বিকল্প ব্যবস্থা না করে আমরা সবার জন্য সবকিছু ঠিক করি।আমিত্ত্ব থেকে বেরিয়ে দেশপ্রেম মানিবকতা জাগ্রত হোক সবার মধ্যে। সবার শুভ বুদ্ধি জাগ্রত হোক।