বিশ্বকাপের আরও আশ্চর্য ঘটনা

ac1015c4c9c02f36bf12ed20d715df4c-5b124fd138256.jpg

চলে এল বিশ্বকাপ ফুটবল। গত পর্বে ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবলের সেই প্রাচীন সময়টার অনেক অদ্ভুত ঘটনা সম্পর্কে জেনেছিলাম। আজ আসুন চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক ১৯৯০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত অদ্ভুত সব ঘটনা সম্পর্কে! লিখেছেন নিশাত আহমেদ
বোনাস পাওয়ার যুদ্ধ
১৯৫৪ ও ১৯৭৪ সালের পশ্চিম জার্মানি দলের মধ্যে একটা বিশাল পার্থক্য ছিল। চুয়ান্নর সে সময়টায় বেতন-ভাতা নিয়ে খেলোয়াড়দের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সবাই নিজের মনের আনন্দে, দেশের সম্মান রক্ষা করার জন্য খেলতেন। কিন্তু চুয়াত্তর আসতে আসতে ফু্টবল খেলার মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবেই ঢুকে গেল। ম্যাচ জিতলে কত বোনাস, শিরোপা জিতলে কত বোনাস, কে কোন ব্র্যান্ডের মুখপাত্র হবেন—এসব বিষয় তখন ফুটবলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হতে শুরু করেছে। তৎকালীন পরাশক্তি পশ্চিম জার্মানি, ব্রাজিল, ইতালি, হল্যান্ড দলগুলোও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
শোনা গেল, বিশ্বকাপে বোনাস হিসেবে ইতালি ও হল্যান্ড দলের প্রত্যেকে ১ লাখ ডি-মার্ক (জার্মানির মুদ্রার নাম ছিল তখন ডি-মার্ক বা ডয়েচ মার্ক) করে পাচ্ছেন। যেখানে পশ্চিম জার্মানি দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের ৩০ হাজার ডি-মার্ক করে পাওয়ার কথা। এ তথ্য জেনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন জার্মান খেলোয়াড়েরা। দাবি করেন ইতালি ও হল্যান্ডের খেলোয়াড়দের সমান বোনাস। বিরক্ত পশ্চিম জার্মানি কোচ হেলমুট শোন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারদের সতর্ক করে দেন, এ ব্যাপার দেশের মানুষ জানলে জাতীয় কাপুরুষ হয়ে যাবেন তাঁরা। কিন্তু তাতে বেকেনবাওয়ার-ব্রাইটনারদের থোড়াই কেয়ার! একসময় মনে হয়েছিল আয়োজক পশ্চিম জার্মানি নিজেরাই মূল দল পাঠাতে পারবে না বিশ্বকাপে। হেলমুট শোন বলেছিলেন, বোনাস নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে তিনি বিশ্বকাপ খেলবেন দ্বিতীয় দল নিয়ে।
পরে ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে ৭৫ হাজার ডি-মার্কে এসে রফা হয় খেলোয়াড়দের। টুর্নামেন্ট খেলতে যায় পশ্চিম জার্মানরা। তবে খেলা দেখেই সবাই বুঝতে শুরু করে, তাঁরা খেলতে ঠিক আগ্রহী নন। বেকেনবাওয়ারদের সঙ্গে ফেডারেশনের যে সম্পর্ক তিক্ত হয়েছিল, তার প্রভাব পড়েছিল মাঠের খেলায়ও। গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে পল ব্রাইটনারের গোলে চিলিকে ১-০ গোলে ও দ্বিতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৩-০ গোলে হারালেও খেলায় ঠিক জার্মানসুলভ ভাব ছিল না, ফলে নিজেদের দর্শকদের কাছ থেকে দুয়ো শুনতে হয় বেকেনবাওয়ারদের। দুয়ো শুনে বেকেনবাওয়ার এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে দর্শকদের দিকে থুতুও দিয়েছিলেন তিনি!

ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত গোল। ফাইল ছবি
ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত গোল। ফাইল ছবি
আর্জেন্টাইনদের পেরু-প্রীতি
১৯৭৮ বিশ্বকাপ হয়েছিল আর্জেন্টিনায়, জিতেছিলও তারাই। এর মাত্র দুই বছর আগেই সেনা অভ্যুত্থানের শিকার হওয়া আর্জেন্টিনার সামাজিক অবস্থা ছিল অনেক খারাপ। স্বৈরশাসক হোর্হে ভিদেলার সেনাবাহিনী তখন ভিন্ন রাজনৈতিক মতের যাকেই পেত, তাঁকে অপহরণ, গুম, হত্যা করত। ফলে বহির্বিশ্বে আর্জেন্টিনার ভাবমূর্তি বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তাই ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপকে ভিদেলা বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেন, সঙ্গে বিশ্বকাপ জয়ের আশা তো ছিলই।
দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচে পেরুকে হারাতে হলে ন্যূনতম চার গোল দিতে হতো আর্জেন্টিনাকে, যেটা তখন একরকম অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল, কেননা তার আগের পাঁচ ম্যাচে পেরু মাত্র ছয় গোল খেয়েছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ম্যাচে পেরুকে ৬-০ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠল আর্জেন্টিনা। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না হোর্হে ভিদেলা পেরুভিয়ানদের সঙ্গে কিছু একটা করেছেন। শোনা গেল, ম্যাচের আগে পেরু ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলেন ভিদেলা। বিশ্বকাপ শেষে দারিদ্র্য-জর্জর পেরুতে ৩৫ হাজার টন গম পাঠায় আর্জেন্টিনা। আর আর্জেন্টিনার ব্যাংকে জব্দ ৫০ মিলিয়ন ডলারও মুক্ত করে দেয় আর্জেন্টাইন সরকার। ভিদেলা কেন সেদিন পেরুর ড্রেসিংরুমে গিয়েছিলেন, সেটা আস্তে আস্তে বোঝা যেতে থাকে!

কুয়েতের পাগলামি
১৯৮২ বিশ্বকাপে কুয়েত তাদের ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান দল নিয়ে গিয়েছিল। কিংবদন্তি ব্রাজিল কোচ কার্লোস আলবার্তো প্যারেইরার অধীনে খেলা সেই কুয়েত দলে ছিলেন প্রতিভাবান স্ট্রাইকার ফয়সাল আল দাখিল, মিডফিল্ডার সাদ আল হুতি, গোলরক্ষক আহমেদ আল তারাবুলসি প্রমুখ। প্রথম ম্যাচে ১৯৭৬-এর ইউরোজয়ী চেক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে প্রত্যাশার পারদটা আরেকটু চড়িয়ে দেয় কুয়েতিরা। কিন্তু পরের ম্যাচেই উড়তে থাকা কুয়েতকে টেনে মাটিতে নামায় মিশেল প্লাতিনির ফ্রান্স। ৪-১ গোলে হারায় তারা কুয়েতকে। আর এই ম্যাচেই ঘটে এক আজব ঘটনা; যার কারণে হয়তোবা কুয়েত এখনো লজ্জিত!

মিলার সেই নাচ! ফাইল ছবি
মিলার সেই নাচ! ফাইল ছবি
সে ম্যাচে ফ্রান্স তখন ৩-১ গোলে এগিয়ে। ম্যাচের শেষ দিকে ফরাসি মিডফিল্ডার আলাইন জিরেস একটা গোল করে স্কোর ৪-১ করে ফেলেন। কিন্তু গোলের সঙ্গে সঙ্গেই কুয়েতিরা অফসাইড দাবি করে বসেন, এমনকি ভিআইপি বক্সে বসে থাকা কুয়েতি ফেডারেশনের প্রধান শেখ ফাহাদ আল আহমাদ আল সাবাহ তড়িঘড়ি মাঠে নেমে আসেন রেফারির সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য! ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো, ম্যাচ থামল কিছুক্ষণের জন্য। তবে আশ্চর্যজনকভাবে রেফারি নিজেই কিছুক্ষণ পর তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টে অফসাইডের সিদ্ধান্ত দিলেন। পরে ফ্রান্স আবার আরেকটা গোল করে স্কোরলাইন ৪-১ বানিয়েই ম্যাচ শেষ করে। সেই যে কুয়েতের ফুটবল ঐতিহ্যে এক কালো দাগ লাগল সেবার, আর সেই দাগ মেটেনি!

হ্যান্ড অব গড, গোল অব দ্য সেঞ্চুরি
১৯৮৬ বিশ্বকাপটা সম্পূর্ণ ছিল ম্যারাডোনাময়। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চার মিনিটের ব্যবধানে যে দুই গোল তিনি করেন, তা একই সঙ্গে যে রকম ইতিবাচক, সে রকম নেতিবাচকও। তবে যা-ই হোক না কেন, এই দুই গোলেই যে ম্যারাডোনা সেই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় তারকা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিক ফকল্যান্ড যুদ্ধের ক্ষত তখনো শুকায়নি আর্জেন্টাইনদের মনে, ম্যারাডোনা একরকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন ইংল্যান্ডকে হারানোর জন্য। সেই প্রতিজ্ঞা থেকেই কিনা, একটা খারাপ কাজ করে বসলেন তিনি। রেফারির চোখের আড়ালে হাত দিয়ে গোল করেন, যে গোলকে তিনি নিজেই পরে ‘হ্যান্ড অব গড’-এর গোল বলে আখ্যা দিয়েছেন!
কিন্তু ঠিক চার মিনিট পরেই যে গোল করেছেন ম্যারাডোনা, তা এখনো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোল হিসেবে সমাদৃত। নিজেদের অর্ধ থেকে দশ সেকেন্ডের এক দৌড়ে ছয়জনকে কাটিয়ে করা সেই গোলের পর ইংল্যান্ডের আসলেই আর কিছু করার ছিল না। বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে ফুটবলের নতুন রাজাকে!
দেখে নিন সেই গোল

রজার মিলার ‘উত্থান’
১৯৯০ বিশ্বকাপে চমকের নাম ছিল ক্যামেরুন। উদ্বোধনী ম্যাচেই নবাগত ক্যামেরুন হারিয়ে দিয়েছিল আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে! কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট শেষ করা ক্যামেরুন পেয়েছিল ‘অদম্য সিংহ’ ডাকনাম। তাদের সাফল্যের নেপথ্যে ছিলেন রজার মিলা নামের একজন। ওই আসরে করেছিলেন চার গোল। কিন্তু এসব কিছুই হতো না যদি ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়া শুধু একটা ফোনকল না করতেন!
১৯৭৩ সালে জাইরে’র বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের এক ম্যাচে অভিষিক্ত রজার মিলার বিশ্বকাপ স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৮২ সালে এসে। সেবারের বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে যায় আফ্রিকার অদম্য সিংহরা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে জায়গা হয়নি ক্যামেরুনের। পরের বছরেই ৩৫ বছর বয়সী রজার মিলা আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। কিন্তু ১৯৯০ সালে ক্যামেরুন বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটির প্রেসিডেন্ট পল বিয়া দেশের সবচেয়ে বড় ফুটবল তারকাকে বিশ্বকাপ খেলার জন্য ফোন করে মিনতি করেন। সে মিনতি ফেলে দেওয়ার মতো পাষাণ ছিলেন না মিলা। ৩৮ বছর বয়সে বিশ্বকাপ খেলতে এসেই তাই একরকম ‘উত্থান’ ঘটে রজার মিলার। আর গোল করার পর তাঁর সেই বিখ্যাত উদযাপন, তা কি কেউ ভুলতে পারে?

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now