কোথায় হারালো পুজোর সেই আন্তরিকতা

আজও পুজো এলেই কেমন যেন শৈশব কৈশোর আর যৌবনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। সকালে পারিবারিক পুজোগুলিতে ছিল আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা। সর্বজনীন পুজোতেও আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা কম ছিল না। আসলে সেদিনের পুজো ছিল আনন্দময়, অনাবিল আনন্দে ভরপুর। কিন্তু সে আনন্দ আজ আর পুজোয় কেমন যেন খুঁজে পাইনা। সেই আন্তরিকতাই বা কোথায়? সেই জায়গা নিয়েছে বৈভব, আড়ম্বর, জাঁকজমক। অথচ আমরা আমাদের কৈশোর-যৌবনে এই জৌলুস, চাকচিক্য, আড়ম্বরের কথা ভাবতেই পারতাম না। আজ সবই যেন কেমন মেকি, কৃত্রিম মনে হয়. আজ এমন কি মুখের হাসিটাকেও কৃত্রিম লাগে।
এখন কলকাতা শুধু নয়, এই বাংলার অন্যসব শহরে, গ্রামে গঞ্জেও দুর্গাপুজোর সেই ঢাকের বাদ্যির আবেদনও ঢাকা পড়ে যায় উদ্যোক্তাদের বৈভব, জৌলুস দেখানোর তাগিদে ও বহরে। পুজোর বহিরঙ্গে এত ঝলকানো আলো আর দীপ্তি, অন্তরঙ্গে কিন্তু ততোধিক আধাঁর। পুজোর আসল যে আচার অনুষ্ঠান, সেটাই ঢাকা পড়ে যায় চাকচিক্যের মাঝে। লক্ষ দেড় উপলক্ষের পিছনে ছোটার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায় সব সময়।
এখন তো পুজোয় বড় লড়াই সাবেকি বনাম থিম। সাবেকি পুজোর পাশাপাশি থিম বন্দনার প্রতিযোগিতা। এখন কে কত ভাবে পুজো মণ্ডপকে সুসজ্জিত করতে পারে সেটাই দেখার। আর এতে উৎসাহ দিতে চলে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার তরফে প্রতিযোগিতার আয়োজনও। পুজো চলাকালীনই জানা যায়, কলকাতার কোন পুজো প্রথম, দ্বিতীয় তৃতীয় হল। চারদিনের মহাযজ্ঞে ভারতের স্থাপত্য ও সংস্কৃতির নিদর্শনের কোনও কিছুই বাদ যায় না মণ্ডপ সজ্জায়। আমাদের কৈশোরে -যৌবনে পুজো দেখতে গিয়ে আলোচনার বিষয় থাকত কোন মণ্ডপে ভালো প্রতিমা দেখেছি তা-ই। তারই ফাঁকে ঝালমুড়ি, ঘুগনি এইসব খাওয়া চলত। কলেজ জীবনে আর একটু বড়ো হয়ে পূজামণ্ডপে ভেজিটেবল চপ, ফিস চপ, মটন চপ, খাওয়া হত, চলত উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতা ঠাকুর দেখা। দর্শকরা নিজেরাই তখন বিচার করতেন কোন প্রতিমা সবচেয়ে ভালো হয়েছে। কলকাতায় বাগবাজার সর্বজনীন পুজো মণ্ডপে এক কাঠামোয় পুজো আজও হয়। কলকাতায় প্রথম গৌরীবেড়েতে এককাঠামো না করে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকের মূর্তি আলাদা আলাদা করার আয়োজন হয়।
মনে পড়ে মহম্মদ আলি পার্কের পাশে কলকাতা ফায়ার ব্রিগেড ভবনে পুজোর কথা। যতদূর মনে পড়ে বছর দুয়েক সেখানে পুজো হয়েছিল। পুজোর সময়ও নানা স্থানে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিন্তু পুজোর দর্শনার্থীদের ভিড়ে দমকল কর্মীদের সেখান থেকে বেরনো মুশকিল হয়ে পড়ত। তাই ওখানকার পুজো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে যে দুবছর ওখানে পুজো হয়েছিল আয়োজকরা সবদিক থেকে মাত করে দিয়েছিলেন।
উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি, আহিরিটোলা, শোভাবাজার সর্বজনীন পুজো মণ্ডপে গিয়ে দেখেছি বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে পুজোর অনুষ্ঠান করত। শিয়ালদহ সর্বজনীন, মহম্মদ আলি পার্ক সর্বজনীন, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজোর বেশ নাম ডাক তখনও ছিল। দক্ষিণ কলকাতায় সংঘশ্রীর প্রতিমা দেখতেও ছুটিতাম আমরা।
সেদিন পুজো মণ্ডপের ডেকরেশনের দিকে বেশি নজর না দিয়ে পুজোর অনুষ্ঠানকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হত। কলকাতার বাইরে রাজ্যের কয়েকটা শহরের পুজো মণ্ডপে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেসব পুজো মণ্ডপও সেদিন খুব প্রাণবন্ত মনে হত। কলকাতার সাবেকি পুজোর মধ্যে নাম করতে হয় শোভাবাজার রাজবাড়ি, শ্যামবাজারের সেনবাড়ি, ভবানীপুরের মল্লিক বাড়ি, বেহালার সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের পুজো।
এখন বেশি নজর দেন উদ্যোক্তারা মণ্ডপসজ্জা ও আলোকসজ্জায়। কোনও বছর কোনও বিশেষ ঘটনা ঘটলে তার প্রেক্ষিতে মণ্ডপসজ্জা করা হয়। তাই এক এক বার এক এক রকম থিম। প্যান্ডেল সজ্জা থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন শিল্প। ব্যাবসাকে আরও প্রসারিত করতে হারিয়ে যাওয়া শিল্পকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার ফি বছর চেষ্টা করছেন শিল্পীরা। কলকাতা শহরে এই থিমপুজোর সূচনা কবে বলা মুশকিল। কলকাতার দেখাদেখি জেলা ও মহকুমা শহরেও ‘থিমপুজো ‘ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আলোকসজ্জাটা কলকাতা প্রায় সময়ই ধার করে চন্দননগর থেকে। চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর আলোকসজ্জার পুনর্ব্যবহার পরের বছর কলকাতার অনেক পুজো মণ্ডপে দেখা যায়।
পুজোর বহিরঙ্গের এই সাজসজ্জার জন্যেই কিন্তু বাজেটের বড়ো অংশটাই ব্যয় হয়ে যায়। আসল পুজোটাই তাই সারতে হয়ে নম নম করে। অথচ আগের দিনে বারোয়ারি পুজোতেও পুজোর ক’ দিন ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা থাকত। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আদর আ্প্যায়নের কোনও ত্রুটি থাকত না, যা আজকাল একরকম দেখাই যায় না।
তখন পুজো প্রাঙ্গণে গানবাজনার আয়োজন করা হত। অনেক প্রখ্যাত শিল্পী আসরে বসে গান গাইতেন। শচীনদেব বর্মন, সুধীর লাল চক্রবর্তী, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সুপ্রভা সরকার, উৎপলা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ত্রী বসু, বাণী ঘোষালরা আসর জমিয়ে দিতেন, জমিয়ে দিতেন কৌতুক নকশায় নবদ্বীপ হালদার, হাসির গানে ডাঃ যশোদুলাল মণ্ডল। দর্শনার্থীরা তা শুনতেন। আবার অনেক পুজোর উদ্যোক্তা পুজোর পর রাতভর জলসার আয়োজন করতেন। এখন এসব আর দেখা যায় না, গেলেও তার চরিত্র বদল হয়েছে। কোথাও কোথাও যাত্রার আসরও বসত।
বারোয়ারি পুজোর উদ্যোক্তাদের চাপ দিয়ে চাঁদা আদায় করতে দেখতাম না, যে যাঁর সাধ্যমতো চাঁদা দিতেন, উদ্যোক্তারা নির্দ্বিধায় তা নিতেন। এখন তো বিলে নামের সঙ্গে টাকার অঙ্ক বসিয়ে দিয়ে উদ্যোক্তারা বলে যান, টাকাটা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। তিনি ওই টাকা দিতে পারবেন কিনা সেব্যাপারে উদ্যোক্তাদের কোনও নজর নেই। অনেকটা রাজনৈতিক দলের বিশেষ বিশেষ দিনে বা বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক চাঁদা দেওয়ার মতো। পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও অনেক শহরে আগের তুলনায় দুর্গাপুজোর আড়ম্বর অনেকটা বেড়েছে। পঞ্চাশের দশক থেকে এ পর্যন্ত পাতিয়ালা, দিল্লি, মুম্বই, কটক, ভুবনেশ্বর, কাশী, পাটনা, শিলং, ইম্ফল, ধানবাদ, সিমলায় দুর্গাপুজোর সময় থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। বছর চার পাঁচ আগেও পুজোর দুদিন শিলঙে ছিলাম, সেখানেও দেখলাম শুধু জৌলুষ আর আড়ম্বর, অথচ এই শিলংয়েই আগে পুজো হয়েছে সাবেকি প্রথায় এবং আন্তরিক নিষ্ঠা নিয়ে। পুজোয় ইম্ফলে এই আন্তরিকতা পেয়েছিলাম। পাঠক শুনলে আশ্চর্য হবেন এই ইম্ফল থেকে আসামের শিলচরে এসেছিলাম ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানে মাত্র ২৩টাকা ভাড়ায়, সেটা ১৯৬৯সাল। বাংলার বাইরে এই দুর্গাপুজো মণ্ডপে অবশ্যে বাংলার সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্য, বাঙালির ঐতিহ্যের অনুভূতির পরশ পাওয়া যায়। অতীতে পাতিয়ালা, দিল্লি, কাশী, জব্বলপুর, মুম্বইয়ে সেই অনুভূতির স্পন্দন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এর মধ্যে দুএক জায়গায় নতুন শতকের প্রথম দশকে গিয়ে আত্মার আত্মীয়তা খুঁজে পাইনি। শহর কলকাতার পুজোয় যেভাবে আন্তরিকতা হারিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেইভাবে হারিয়ে যাচ্ছে রাজ্যের বাইরেও। বাড়ছে সেখানে বৈভব, আড়ম্বর, জাঁকজমক। সোনা, পেট্রোলসহ সব জিনিসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে যতই বাড়ছে, পুজো ও সামাজিক অনুস্ঠানে আড়ম্বর, জাঁকজমক ততই বেড়ে চলেছে।

(সুজয় বিশ্বাস)

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now
Logo
Center