সময়ের ডাক: পর্ব-১

একঢল রক্তের ফোয়ারার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে প্রান্তিক।টকটকে লাল রক্ত জমাট বেঁধে দগদগে আঁঠার ন্যায় লেপ্টে আছে তার শরীরের সাথে।প্রান্তিকের তাতে কোনো হেলদোল নেই।সে চুপচাপ স্থির চোখে আকাশ দেখছে।চোখজোড়া কেমন যেন ফ্যাকাশে পড়ে গিয়েছে।তবুও সে চোখজোড়ার অন্তড়ালে জট পাঁকানো ভয়ানক আর্তনাদ উপস্থিত যেকোনো প্রাণীকে আপাদমস্তক কাঁপিয়ে তুলতে সক্ষম।তার মা দিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে এক পাশে বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছেন।প্রতিবেশিদের একদল তাকে সামলাতে ব্যস্ত।তবে আরেকদল লোক শান্ত চোখে লালচে ইটের রাস্তা জুড়ে মাখানো রক্ত প্রবাহের গভীরতা পর্যবেক্ষণ করছেন।পূর্বের মূত্যুগুলোর তুলনায় এবার রক্ত কি কম অপচয় হলো?না নিশ্চিত নয়,বেশিও হতে পারে! অনেকটা দূরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে সতেরো বছর বয়সী নীলিমা।হয়তো ভাবছে তার ভাইয়ার দেহটা যখন উপর থেকে আছড়ে পড়ল,তার মগজের খোলসটা ঠিক কিভাবে ফেটেছিল?মুরগির ডিম ফাটার মতো করে কি?মাথার ফাটলের অংশ থেকে বেরিয়ে আসা সাদা সাদা মগজের টুকরো গুলোও রক্তের মাঝে লুটোপুটি খাচ্ছিল।নীলিমা অবাক হয়।এই দলা পাকানো বস্তুগুলোর বদলৌতেই কিনা তার ভাইয়া ভার্সিটিতে রেংক করত?অথচ এগুলো দেখতে কি অদ্ভুত!

pexels-pixabay-162389.jpg


ঘন্টা খানিকের মধ্যে পুলিশ আসে।তল্লাশি চালায়।প্রশ্নের দাপটে প্রতিবেশীদের নাজেহাল করে ছাড়ে।তদন্ত জারি রাখে।তবুও কোনো সুরাহা হয় না।গত ছয়টি আত্মঘাতী মৃত্যুর মতো এবারও শুন্য হাতে ফিরে যেতে হয় তাদের।গত কয়েক মাস যাবৎ এ মহল্লার গোলক ধাঁধায় চক্কর কাটছে পুলিশ ফোর্সের এই দল।এই তো গতকালও পাশের গলি থেকে মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তদন্ত চালিয়ে গেছে।মৃত্যু ধরন আলাদা,তবে শিরোনাম এক।আত্মহত্যা! বিলেতি ভাষায় যাকে বলে,‘সুইসাইড’।গতকাল পাশের গলির মেয়েটা জীবন দিয়েছে কব্জির শিরা ছেদ করে আর আজ এ ছেলে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে পৃথিবীকে বিদায় জানালো।অথচ এ ছয়জন তরুণ তরুণীর কারোই জীবনের প্রতি কোনো প্রকার অভিযোগ ছিল না।বড়ই অদ্ভুত!তবে তারা এভাবে একের পর এক জীবন দিচ্ছে কেন?ময়নাতদন্তের রিপোর্টও পরিষ্কার...!
.
ভাইয়ের অপঘাতী মৃত্যুতে নীলিমার পরিবার শোকাহত,প্রচন্তরূপে হতাশাগ্রস্ত।তাদের সমস্ত আনন্দগুলো যেন কালো মেঘেরা গ্রাস করেছে।একমাত্র ভাইয়ের চোখের মণি ছিল নীলিমা।সে ভাইকে হারিয়ে আজ নীলিমা ভীষণ ছন্নছাড়া।না চাইতেও চোখের তলায় একরাশ কালি ভিড় জমিয়েছে।

মধ্যরাতের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় নীলিমার।সচারচর মধ্যরাতে ঘুম ভাঙ্গে না তার।বাবা বলেন,নীলিমার ঘুম বেশ কড়া।তাকে জাগানো সহজ কর্ম নয়!প্রচন্ত জল তেষ্টা পেয়েছে।অনুভব হচ্ছে যেন কালমেঘের ন্যায় কিছু একটা গলার কাছে বিঁধে আছে।যন্ত্রণা হচ্ছে।আর সহ্য হয়না!গা ছমছমে নীরবতা জড়ানো অন্ধকারের মাঝেও নীলিমা চলে যায় ড্রইংরুমের দিকে।তাড়াহুড়োয় মোবাইলটাও সঙ্গে নেয় নি।যেন অস্বাভাবিক ভাবেই সে তার আশেপাশের পরিবেশের কথা ভুলে গিয়েছে।খাবার টেবিলের উপর পানিভর্তি জগটা রাখা আছে।নীলিমা দ্রুত এগিয়ে এসে ঢকঢক করে জগের অর্ধেক পানিই গিলে নেয় তবুও যেন তৃষ্ণা মেটে না।বরং আরো দ্বিগুণ হয়।মিনিট কয়েক পর নীলিমা চারদিকে চোখ বুলালো।ভয়ংকর নীরবতার ভয়াবহতা অনুভব হতেই সারা শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে তার।পানির জগটা জায়গা মতো রেখে দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে।

"নীলিমা..নীলিমা...."

"কে!"

ভাইয়ার রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ পেছন থেকে কারো গলা পেয়ে হতচকিয়ে উঠল নীলিমা।পা যেন ওখানেই জমে গিয়েছে।কি ভয়ংকর শীতল কন্ঠ।নীলিমা এক চুলও নড়তে পারছে না।ভয়ে তার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে।আবার কেউ ফ্যাসেফ্যাসে গলায় ডেকে উঠল,

"এই নীলি..শুনতে পাচ্ছিস?এদিকে একটাবার আয় না,বোন আমার।আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে!"

নীলিমা পেছন ফিরে তাকায়এ কন্ঠ যে তার ভীষণ চেনা।আবেগী গলায় চেঁচিয়ে ওঠে,

"ভাইয়া!"

pexels-juan-c-palacios-3585607.jpg

নীলিমা চোখের জল মুছে প্রান্তিকের ঘরের বন্ধ দরজার উপর হাত রাখে।কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করে।ভেতরে কি কেউ আছে?হ্যাঁ,কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।নীলিমা আর নিজেকে আটকাতে পারে না।দরজার নব ঘুরাতেই দরজাটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল।রুমের উত্তর পাশের জানালাটা খোলা।চাঁদের আলো হুড়মুড়িয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে।চারপাশটা আবছা আলোয় মো মো করছে যেন।জানালার ঠিক পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।নীলিমার ঠোঁট প্রশস্ত হয়।চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে।ভাইয়া ফিরে এসেছে!ভাইয়া কোথাও যায় নি...ভাইয়া তো এখানেই আছে!নীলিমা ছুটে গিয়ে ঝাপটে ধরে ছায়ামূর্তিটিকে।বেসামাল হয়ে কাঁদে।

"ভাইয়া,আমি জানতাম তুমি আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারো না!আমাদের ছেড়ে আর কোথাও যাবে না তুমি,কথা দাও?মা কত কেঁদেছে তুমি জানো?এমনটা কেন করলে বলো?বলো না,ভাইয়া?"

উন্মাদের মতো কাঁদছে নীলিমা।হঠাৎ প্রচন্ড বিদঘুটে একটা দুর্গন্ধ নীলিমার নাকে বাড়ি খায়।এতটাই তীব্র সে দুর্গন্ধ যে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু নীলিমা তার তোয়াক্কা করে না।নিজের মতো করেই বিরবির করতে থাকে।তবে অপাশ থেকে থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বিরক্ত হয়।

"কিরে ভাইয়া?কিছু বলছিস না কেন?"

অস্থির হয়ে নীলিমা ছায়ামূর্তিটির হাতের দুটি আঙুল চেঁপে ধরল।ঝাঁকি দিতেই মনে হলো যেন তার হাতের মুঠোয় কিছু একটা চলে এসেছে।ভ্রুজোড়া কুঁচকে মুঠো খুলতেই দুটো অর্ধগলিত বিচ্ছিন্ন আঙুল তার মুঠো থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।নীলিমা কি বিস্ফোরিত চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে।কি ভেবে চোখ তুলে তার সামনে থাকা ছায়ামূর্তিটির দিকে তাকাতেই কয়েক পা পেছনে সরে যায় নীলিমা।এটা তো ভাইয়া নাহ!তাহলে কে!আবছা আলোয় ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়।তার চেহারা দেখতে পেতেই প্রচন্ড শব্দে চিৎকার করে ওঠে নীলিমা।অর্ধগলিত বিভৎস সে মুখমণ্ডল চুইয়ে চুইয়ে কালচে রক্ত গড়াচ্ছে।চিবুকের হাড় বেরিয়ে এসেছে।চোখের মনি ক্ষত-বিক্ষত।কেউ যেন ধারালো পেরেক দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলেছে চোখ দুটো।নীলিমা প্রাণপণে চিৎকার করে যাচ্ছে।কিন্তু তার চিৎকার এ ঘরের বাইরে অবধি পৌছাচ্ছেই না।কেউ আসছে না তাকে বাঁচাতে।নীলিমা এলোমেলো পায়ে পেছোতে থাকে।হুট করে পেছনে কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেতেই ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকায়।তার চোখের সামনে দুটো পা হাওয়ায় ভাসছে।নীলিমা চোখ তুলে ওপরে তাকালো।সিলিং ফ্যানের সাথে একটা মেয়ের লাশ ঝুলে আছে!

TO BE CONTINUED.....

Pictures are taken from pexels.com

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now