মনের কুঠুরির বন্ধ দরজাগুলো...

আমাদের দেখা হয়েছিল চার হাজার পাঁচশত কোটি বছর আগে। যখন বাতাসে হাজার মাইল ধেয়ে আসা ধুলিকনা মরুর বুকে চুমো খেয়ে গড়ে তুলেছিল সুবিশাল পাথুরে পর্বতমালা। এরপর এত কাল চলে গেল, সেই আমাদের আর দেখা হয় নি!

Source: Pixabay

কয়েক বছর আগের কোনো এক মন খারাপের রাতে এই লাইনগুলো লিখে রেখেছিলাম। আজ হঠাৎ মেমরিতে লেখাটা দেখতে পেলাম। লেখাটা চোখে পড়া মাত্রই পুরানো কিছু জমে থাকা ঘুমন্ত স্মৃতি জেগে উঠলো। যদিও এসব স্মৃতি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকলেই ভাল। জেগে উঠলে নতুন করে মনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়।

কোনো এক ঔপন্যাসিকের উপন্যাস পড়ার সময় একটা লেখা পড়েছিলাম। লেখাটা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। মানুষের মনের ভেতর অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠুরি আছে। সেসব কুঠুরির একেকটাকে একেকজন মানুষ থাকে, একেকটা স্মৃতি থাকে। সময়ের সাথে সাথে সেই মনের কুঠুরিগুলোর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ধীরে ধীরে সেসব দরজায় ধুলোবালি জমতে থাকে। দীর্ঘদিন অব্যাবহৃত থাকার পর হুট করে কোনো একদিন হয়তো সেই দরজাটা খুলে যায়। সেই কুঠুরিতে আটকে পড়া কিংবা জমে থাকা স্মৃতিগুলো বেড়িয়ে আসে।

কোন উপন্যাসে পড়েছিল, সেইটা মনে আসছে না। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। তবে ঔপন্যাসিক কিংবা উপন্যাস, কোনোটার নামই আমার লেখায় গুরুত্বপূর্ণ না। কিন্তু এই কথাগুলো আমার পছন্দের। যখনই জীবন নিয়ে আলাপ করি, এই কথাগুলো আমি উদাহরন হিসেবে উল্লেখ করি।

যায় হোক, জীবন থেমে থাকে না, এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মাঝে মাঝে অনেকেরই জীবন থেমে থাকে৷ বাইরে থেকে তা হয়তো বুঝা যায় না৷ কিন্তু আমাদের আশেপাশের কিছু মানুষ আছে, যারা তাদের জীবনকে থামিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত, আবার কেউবা মনের অজান্তে। নির্দিষ্ট একটা গন্ডির মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছে জীবন। সত্যি কথা বলতে কী, আমিও একসময় তাদেরই দলে ছিলাম। দিন যাচ্ছিল, বয়স বাড়ছিল, অথচ মানসিক দিক দিয়ে আমি একটা জায়গাতেই আটকে ছিলাম, যেখানটাতে প্রিয় মানুষটা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল।

তবে মানুষের জীবন চলমান। জীবন যেমন প্রতি মুহুর্তে পরিবর্তিত হয়, ঠিক তেমনি প্রিয় মানুষগুলোর নামও পরিবর্তন হয়। ছোট বেলায় বিজ্ঞান বইতে শক্তির সংঙা শিখতে গিয়ে পড়েছিলাম শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। শক্তি শুধু এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়। বহু বছর পর আমার কাছে মনে হয়েছিল ভালবাসাটাও ঠিক একই রকম। এর সৃষ্টি বা বিনাশ নেই। আমাদের ভালবাসা শুধু সময়ের প্রেক্ষিতে এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের কাছে ছুটে চলে।

একটা সময় চট্টগ্রামে নিয়মিত যাওয়া হত। আমার সবচেয়ে পছন্দের শহরগুলোর মাঝে চট্টগ্রাম অন্যতম৷ এখনোও পছন্দের তালিকাতেই আছে, কিন্তু আগের মতো আর যাওয়া হয় না। একটা সময় ছিল, যখন সুযোগ পেলেই ট্রেইনে চড়ে চট্টগ্রাম চলে যেতাম। চট্টগ্রামের খুলশি থেকে জিইসি মোড় হয়ে বহাদ্দারহাট পর্যন্ত রাস্তাগুলোতে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে জিইসির মোড়ে হেঁটে বেড়ানোর গল্পগুলো নাহয় অন্য কোনো দিন বলব।

বহাদ্দারহাটের কথা উঠায় একটা তথ্য শেয়ার করার ইচ্ছে হচ্ছে খুব। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বড় ভাইকে বদ্দা বলে৷ তো আমি ভেবেছিলাম সেই বদ্দা থেকেই হয়তো বহাদ্দারহাটের নামকরন করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দহনকাল পড়ার সময় জেনেছিলাম বহদ্দা মূলত সেসময়ের শুটকি/মাছ ব্যাবসায়ীদের ডাকা হতো৷ এইসব বহদ্দাররা বহদ্দারহাটে বসে শুটকি/ মাছ বেঁচাকেনা করতো বিধায় জায়গাটার নাম বহদ্দারহাট হাট হয়ে গিয়েছে।

বলে রাখা ভাল, মানুষের নাম কিংবা এলাকার নামের অর্থ বা পেছনের গল্পগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ প্রবল। সেকারণেই যখন যেখানে যাই বা যখন যে নামগুলো চোখের সামনে পড়ে, তখন সেই নামগুলোর অর্থ বা পেছনের গল্পগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। সবসময় অবশ্য সফল হই না, কিন্তু যেগুলো খুঁজে বের করতে পারি, সেগুলো সবসময় মনে রাখার চেষ্টা করি। এসব নিয়েও নাহয় অন্য কোনো দিন আলাপ করা যাবে।

যায় হোক, আগেই বলেছি জীবন থেমে থাকে না। চলমান জীবনের সাথে সাথে একসময় থেমে থাকা আমার জীবনটাও পুনরায় চলতে শুরু করেছে। আগের গন্ডি থেকে বের হয়ে এসেছি৷ প্রিয় মানুষটাও বদলে গিয়েছে। এখন যে আছে, তার সাথেই আজীবন থাকতে হবে। তাই শুধু মনের কুঠুরিগুলোর বন্ধ দরজাগুলো হুট হাট খুলে গেলেও লাভ হবে না৷ হয়তো একটু আধটু কষ্ট হবে। কিন্তু সেই কষ্টগুলোও সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাবে৷ যেসব কষ্ট কিংবা গল্পগুলো হারিয়ে যায়, সেসব নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে নেই।

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now
Logo
Center