আত্মহত্যা নাকি খুন?

কনস্টেবল রশিদ মিয়ার আজ মন মেজাজ ভালো নেই।চেহারায় কেমন যেন কান্না কান্না ভাব। বুড়ো মানুষ। বয়স ধারণা করা যায় কমপক্ষে ষাট।উনি অবশ্য বলেন পঞ্চাশ এর বেশি নয়।বোধহয় রিটায়ারমেন্টের ভয়ে। ছোট মেয়েটার বিয়ে দিতে টাকা সঞ্চয় করছিলেন। কিন্তু আফসোস! গতরাতে কে যেন গরিবের এই সামান্য ধন চুরি করে নিয়ে গেছে। পুলিশের বাড়িতে চুরি! লজ্জায় কাওকে বলতেও পারছেন না।গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে পল্টুর মুখে এসবই শুনছিলেন এস আই রনি। পল্টু থানার সামনে চায়ের দোকানে কাজ করে।প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল-সন্ধ্যা থানায় এসে সবাইকে চা দিয়ে যায়। রনির বেশ আদরের সে।চা দিতে এসে নানান খোশ গল্প করে।মাঝেমাঝে চায়ের দাম ছাড়াও রনির কাছ থেকে আলাদা বকশিশ ও পায়।
আজ সকালে চা দিতে এসে আক্ষেপের স্বরে জানালো, বুড়ো রশিদ মিয়া তাকে ঝারি দিয়েছে! রনি সাহেব কারন জানতে চাইলে সে এ ঘটনা বলে বলল এগুলো নাকি স্বয়ং রশিদ মিয়াই সকালে চা খেতে খেতে তাকে বলেছে।শুনে পল্টুর মায়া হয়। চায়ের দাম টা আর নিতে চায়না সে।ব্যাস রশিদ মিয়া গেলেন ক্ষেপে! ঝারি দিয়ে বললেন, "চুরি হয়েছে বলে ভেবেছিস কি চা খাওয়ার টাকা ও নেই আমার কাছে? "

রনি সব শুনে মুচকি হাসলেন। পল্টুর হাতে একশ টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে বললেন, " মন খারাপ করিস না। এগুলো দিয়ে যা খেতে ইচ্ছে করে খা গিয়ে।"
পল্টুকে আনন্দিত দেখালো। রনি আরো বললেন, "যাওয়ার সময় রশিদ মিয়া কে ডেকে পাঠাবি।"
পল্টু চলে গেলো।কিছুক্ষণ বাদেই রশিদ মিয়া হাজির হলেন। রনি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, "চলুন আজ আপনার বাড়ি যাবো। কার এতো সাহস পুলিশের বাড়িতে চুরি করে? "
রশিদ মিয়া অবাক হলেন।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, " খুব সামান্য টাকা স্যার।"
রনি কিছু না বলেই থানা থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। বাধ্য হয়ে রশিদ মিয়াও পেছন পেছন গেলেন।যেতে যেতে বিরবির করে বললেন, "হতচ্ছাড়াটার পেটে কিচ্ছু থাকেনা!"

গাড়ি ছুটছে রশিদ মিয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সে পর্যন্ত না পৌঁছুতেই বিশাল জ্যামে পড়তে হলো। রনি সাহেব খেয়াল করলেন তাদের ঠিক বাম পাশ টায় একটা বড়সড় ভির। রশিদ মিয়াকে গিয়ে দেখতে বলবেন ভেবেও বললেন না। নিজেই নামলেন। ভির ঠেলে ভেতরে গিয়ে দেখলেন গেইট বন্ধ। উপরে বড় অক্ষরে লেখা "নূরে আলম আলিয়া মাদ্রাসা" আশেপাশের মানুষের কাছে ভিরের কারণ জানতে চাইলেন। একজন কে কর্কশ কণ্ঠে বলতে শোনা গেল, "এতোক্ষণ পরে আইলেন তাও আবার ঘটনা না জাইনাই! "
কথাটা কে বলল ভিরের মধ্যে ধরা গেলো না। অন্য একজন কে বলতে শোনা গেলো একটা ছাত্র নাকি আত্মহত্যা করেছে।
pexels-photo-64699.jpeg
এস আই রনি এবার রশিদ মিয়াকে ফোন করে আসতে বললেন। গেইট ধাক্কাতে লাগলেন তিনি। কেউ খুললো না।হয়তো বা খুলতে চাইলো না।জোরে ধাক্কালেন আরো! বেশ কয়েকটা ধমকের পর কাজ হলো। রনি সোজা হেঁটে ভেতরে চলে গেলেন। দেখলেন একটা বডি বিছানায় মুড়িয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভীষণ রাগাণ্বিত দেখালো ওনাকে। রশিদ মিয়া ততোক্ষণে হাজির। রনির চেহারা দেখে কি যেন বুঝলেন। ধমকে বডিটা নিচে নামাতে বললেন।রনি এগিয়ে গিয়ে জিগেস করলেন, "কি করে কি হলো?"
মোটামুটি স্বাস্থ্যবান একটা লোক এগিয়ে এলো।বলল, "লাফ দিয়ে পড়েছে স্যার।আত্মহত্যা করেছে।"
রনি লোকটার পরিচয় জানতে চাইলে লোকটা বললো সে বশির উদ্দীন। মাদ্রাসার আল কোরআনের শিক্ষক।
রনি জিগেস করলো," আপনি কি করে জানলেন আত্মহত্যা করেছে?"
"আর নয় তো কি?" বশির পাল্টা প্রশ্ন করলো।
রনির আওয়াজ উঁচু হলো এবার।হুংকার দিয়ে জানতে চাইলেন, "পুলিশ কেন ডাকা হলো না?"
বশিরউদ্দীন কে এবার খানিকটা ভীত দেখালো। তবুও কণ্ঠে জোর এনে বললেন,"প্রিন্সিপাল স্যার মানা করেছেন।"
রশিদ মিয়া রনি কে বললেন, " স্যার আপনি ঠাণ্ডা হন।আমি থানায় ফোন করেছি। সব ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।আর প্রিন্সিপাল ও আসছে।"
রনি বডিটার কাছে গেলেন। ফর্সামতো একটা ছেলে। বয়স ১৫ কি ১৬ হবে। আঘাত বলতে শুধু মাথা টা ফেটে গেছে। আর কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখা গেলো না।
মিনিট দশেকের মধ্যেই প্রিন্সিপাল হোসেইন সাহেব এলেন।রনির সামনে এসেই লম্বা করে সালাম দিলেন।কিছু জিগেস করার আগেই বললেন,"স্যার আমি এসেই থানায় খবর দিতাম।তাই ওদের মানা করেছিলাম"
রনি কড়া গলায় বললেন,"কেন? প্রাথমিক ইনভেস্টিগেশন করতে চেয়েছিলেন?"
প্রিন্সিপাল বললেন, " না স্যার! শিক্ষাপ্রতিষ্টানে পুলিশ! বুঝতেই পারছেন। আমরা তো কল্পনাও করতে পারিনি এমন কিছুও কখনো হবে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকেই সবকিছু করতে চেয়েছিলাম।"
রনি মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিলেন না।বললেন," বডিতে হাত লাগাতে কে বলেছিলো?"
প্রিন্সিপাল বললেন," সেটা জানিনা স্যার। আপনি আপনার তদন্ত চালিয়ে যান। যখন যা সাহায্য লাগবে আমরা করবো।"

রশিদ মিয়া দুজন ছাত্রকে নিয়ে হাজির হলেন। বললেন, "স্যার ছেলেটার নাম সাফি।দশম শ্রেণির ছাত্র। মা বাবা নেই। এতিম! খুব মেধাবী ছাত্র স্যার। আর এরা দুজন ফুয়াদ আর আবিদ। আবিদ সাফির সবচেয়ে কাছের বন্ধু।এরা দুজনেই সাফির রুমমেট। রনি আবিদের কাছে জানতে চাইলেন সাফি কোনো মানসিক চাপের মধ্যে ছিলো কিনা।
আবিদ বলল," না স্যার।ও তো সবসময় বেশ হাসিখুশি থাকতো।"
রনি জিগেস করলেন,"তোমার কি মনে হয় ও আত্মহত্যা করেছে?"
আবিদ কে ব্যাথিত দেখালো খুব।বলল, "জানিনা স্যার কিচ্ছু জানিনা। ও এমনটা করতেই পারেনা!" কান্নায় ভেংগে পড়লো সে।রশিদ মিয়া তাকে নিয়ে গেলেন।"
রনি এবার ফুয়াদ কে কাছে ডাকলেন।জিগেস করলেন," ওর মধ্যে কখনো আত্মহত্যার প্রবণতা দেখেছো?"
ফুয়াদ দৃঢ় কণ্ডে বললো," না স্যার।ও তো লেখাপড়া করে অনেক বড় হতে চেয়েছিলো। রাত জেগে পড়াশোনা করতো!"
রনি কপাল কুঁচকে জিগেস করলেন," কাল রাতে কয়টা পর্যন্ত জেগে ছিলো ও?"
ফুয়াদ বলল,"স্যার আমি ১১ টার দিকেই ঘুমিয়ে যাই কাল। রাতে অবশ্য একবার ঘুম ভেংগেছিলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ১ টা বেজে ১৮ মিনিট। পেছনে ফিরে দেখি সাফি তখনো পড়ছে।তারপর আমি আবারো ঘুমিয়ে যাই।"
"কোনো কিছু শুনেছো? কোনো শব্দ? বা ও যখন রুম থেকে বেরিয়ে গেলো টের পেয়েছিলে?", জিগেস করলো রনি।
ফুয়াদ জানালো তার ঘুম বেশ গভীর।এমন কিছুই সে শুনতে পায়নি। রনি সব শুনে ফুয়াদকে যেতে বললেন।ফুয়াদ দুকদম গিয়ে আবার ফিরে এলো। বলল, "স্যার আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয়না ও আত্মহত্যা করেছে।কেন করবে? কোনো কারণই তো নেই! আমার মনে হয় আদিব ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।"

"আদিব কে?", রনি জানতে চাইলেন।
ফুয়াদ উত্তর দিলো," আমাদের প্রিন্সিপালের ছেলে।আমাদের সাথেই পড়ে।ওকে নিয়ে সব শিক্ষকরাই পারশিয়ালিটি করে। এমনকি খাতায় ও অন্যায়ভাবে নম্বর বেশি দেয়। সাফির তা একদমই পছন্দ ছিলো না।প্রতিবাদ করে বসতো সে।এ নিয়ে ওদের দুজনের মাঝে দ্বন্ধ লেগেই থাকতো স্যার।আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আদিব অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে থাকে।ছাদে গিয়ে সিগারেট খায়!
pexels-photo-4046895.jpeg

রনির কপালে ভাজ পরলো।ফুয়াদের পিঠ চাপরে ধন্যবাদ জানালেন।রশিদ মিয়া এসে জানালেন নাইটগার্ডকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রনি জানতে চাইলেন,"কি বললো সে?"
রশিদ মিয়া বললেন," গতরাতে সে নাকি ধুপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনেছে।খুব একটা আমলে নেয়নি বলে আর গিয়ে দেখেনি।কিন্তু শব্দ টা ছোট নয়। আমার মনে হয় তখনই ছেলেটা ছাদ থেকে পড়েছে স্যার।"
রনি বললেন,"হুম! কয়টা নাগাদ শুনেছে শব্দ টা?"
"১ টা ১৫ মিনিটে।", রশিদ মিয়া উত্তর দিলেন।
রনির চক্ষু প্রসারিত হলো।বললেন," তা কি করে সম্ভব!"
রশিদ মিয়া প্রশ্ন করলেন, "কেন স্যার? কেন সম্ভব নয়?"
রনি কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে আত্মবিশ্বাসের স্বরে বললেন,"বডিটাকে ময়না তদন্তে পাঠান।এটা আত্মহত্যা নয় পরিকল্পিত খুন!"

TO BE CONTINUED.....

Pictures are taken from pexels.com

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now