দীপ্তিমান

জিতুদা মারা গেলেন আজ সকালে।
দেখা করবো করবো করে আর সুযোগ হয়ে ওঠলোনা। শেষ দেখা হয়েছিলো বোধহয় গতবছর আমাদের আড্ডাখানা, গিরিতে।
সম্ভবত কাছের মানুষের মৃত্যু এটাই প্রথম আমার জন্য। এর আগে যারাই মারা গিয়েছিলেন, তাদের বিয়োগ ব্যথা তেমন স্মরণে নেই। এমন না যে আমি শোকে কাতর। অথচ হওয়া উচিৎ, কিছুটা হলেও।
কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে, মরে গিয়েই ভালো হলো। এমন নিষ্ঠুর দোয়া কে কার জন্য করে!
কিন্তু আমি করেছি বহুবার জিতুদা'র জন্য।

জিতুদার ক্যান্সার হয়েছিলো বছর ঘুরেছে। কপাল খারাপ বলবো নাকি যা হয় ভালোর জন্য হয় বলে ইতি টানবো জানিনা।
ভুল চিকিৎসার কারণে ক্যান্সারটা ধরা পড়ে এসে একদম শেষ পর্যায়ে।
তবে তখন থেকেই চেষ্টার কমতি ছিলোনা। প্রথম যখন খবরটা শুনি কিভাবে নিব বুঝে উঠতে পারিনি। হৃদয় ভেঙেছিল যখন চিকিৎসার মাঝখানে গিরিতে দাদার সাথে দেখা হয়।
অমন তাগড়া নওজোয়ান, শুধু পাহাড় না পর্বতও চষে বেড়িয়েছে। দেশে অনুষ্ঠিত কোনো ম্যারাথন যে বাদ দেয়না অংশ নিতে, কি রানিং কি সাইক্লিং কি মাউন্টেইনিয়ারিং!
কোনো কিছুতে জিতুর অংশগ্রহণ নেই এ হতেই পারেনা।

আমি যখন শৈবালকে জিজ্ঞেস করলাম "অ্যাই শৈবাল! জিতুদা কখন আসবে" সবাই আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। দেড় হাত দূরত্বে থাকা একটা অবয়ব হেসে বলে ওঠলো- "কিরে তোর কি চশমা আরেকটা লাগবে নাকি, একটাতেতো বোধহয় কাজ হচ্ছেনা!" আমি ঠাহর করে দেখলাম হার জিরজিরে একটা অবয়ব। অথচ সেরকম নওজোয়ান জিতুদা প্রায় অনেকক্ষণ যাবত আমারই সামনে বসেছিলেন, অথচ আমি চিনতে পারিনি উনাকে এমন শীর্ণ, জীর্ণ অবস্থা!
আমি পরিণতার মত আচরণ করতে পারিনি, পারিনি কিছুইনা বলে হেসে উরিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করে গল্প করতে। দু চারটে কুশল বিনিময় করে আমি উঠে চলে এলাম। একটা সিগারেটের জন্য মন আকুপাকু করছে। শৈবাল, অনু আর জাবেদও বেরিয়ে এলো। আমরা কেউ কোনো বাক্যালাপ করলাম না।

আমরা সবাই মাউন্টেইনিয়ারিং ক্লাবের সদস্য ছিলাম। আমার কাছে সবপচেয়ে স্মরণীয় থাকবে যে রাতে আমরা একদিনের জন্য ঢাকা থে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম মাউন্টেনিয়ারিং গিয়ার প্র্যাকটিস করতে। সীতাকুন্ডের বিভিন্ন ঝর্নায় আমারদের প্র্যাকটিসগুলো হয়। জিতুদা হলেন গ্রুপের সেই ব্যক্তি যে থাকলে মাঝ রাত্রেও খানা খন্দে পাহাড় পর্বতে ভ্রমণ করতে কোনো দুশ্চিন্তা হয়না।

মেডিক্যাল প্রফেশনে যুক্ত থাকায়, মৃত্যু কম দেখা হয়নি। কিন্তু জিতুদা'র মৃত্যুটা যেন কেমন লাগছে। ঠিক আবেগী করেছে তা না। হঠাৎ করে সব কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে। কেমন ফাঁকা, নিগূঢ় একটা দলা পাকানো অনুভূতে বুকের ভেতর শক্ত হয়ে জমে আছে। মাসির কথা ভুলেও মনে করতে চাচ্ছিনা, সেই সাহস হচ্ছেনা। সবার মত রেস্ট-ইন-পিস আর স্মৃতিকাতর হয়ে কিছু বলতেও ইছে হয়নি। সারাদিন শেষে শুধু শৈবালের সাথে একটু কথা বললাম। আর কেবল সারাদিন এখানে ওখানে খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। কি যেন ভাবছি, আবার কিছুই ভাবছিনা।
এরকম অনুভূতি আগে কখনো হয়নি।

জিতুদার সাথে আমার শেষ স্মৃতিটাও ছিল, আমাদের প্রিয় খৈয়্যাছড়া ঝর্নাতেই। র‍্যাপলিং, জুমারিং, রিভার-ক্রসিং প্রতিযোগিতা চলছে। আমি আর অপুদি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেছিলাম শুধু জিতুদাকে চিৎকার করে উৎসাহ দিতে।
চূড়া থেকে চিৎকার করছি "হ্যাঁ হবে হবে জিতুদা। পারবে তুমি। সাদাবভাই এগিয়ে গেলতো। তাড়াতাড়ি করো! মোটামুটি গলা ভাঙার উপক্রম হয়েছিল সেদিন।
মনে আছে আমাদের লাফালাফি দেখে শিহাব ভাই পর্যন্ত লক্ষ্য করেছে। "কি মৌ, তোমরা জিতুর ফ্যান ক্লাব নাকি!"
আহারে জীবন।

জিতুদা যতদিন বেঁচেছিল, তার নামের মত সে নিজেও দীপ্তিমানই ছিল। সবসময় সবার মাঝে ঝরঝরে হাসি আর আলোর মত উজ্জ্বল ছিলো।
ওপারে ভালো থেকো জিতুদা।
এই প্রকৃতি, পাহাড়, পর্বত, তুমি স্মরণে রইবে জীবনের বহু স্তরে।

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now