আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এক বিস্মৃত প্রায় কবি.. জাতীয় পাঠ্যপুস্তকের মাগো ওরা বলে কবিতার কারণে আমরা তাকে এখনো মনে রেখেছি.. কিন্তু তার শ্রেষ্ঠ কবিতা আমি কিংবদন্তির কথা বলছি নিয়ে এখন খুব একটা আলোচনা হয় না.. এমনকি এই যুগের অনেক সাহিত্যমোদী এই কবিতাটির কথা জানে না।
বাংলা সাহিত্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ একটি হতাশার নাম.. অসম্ভব প্রতিভাবান এই কবি তার প্রতিভার পরিপূর্ণ ব্যবহার করে যেতে পারেন নি.. সরকারি উচ্চপদস্থ চাকরির ও দায়িত্বের সুবাদে ব্যস্ততার কারণে.. এবং বিভিন্ন কবিতা পাঠের আসর ও কবিতা আড্ডা থেকে দূরে থাকার কারণে সম্ভবত.. তার মাঝে উদ্যমের অভাব ছিল।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের চেয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ধারায়, ব্যতিক্রমী ভাষায় এবং ব্যতিক্রমী ছন্দে কবিতা লিখেছেন.. যে কারণে তাঁর কবিতা কারো দ্বারা প্রভাবিত বলে কখনোই মনে হয় নি.. এমনকি তাঁর সময়ের অন্যান্য দেশখ্যাত কবি- শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দীন, ওমর আলী সহ অন্যরা- তারাও প্রথম জীবনে বিভিন্ন কবি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন.. কিন্তু তিনি একেবারে জীবনের শুরু থেকেই নিজের একটি কাব্যভাষা এবং ধারা তৈরি করেছেন.. আর তার প্রতিভার স্ফুরণ হয়েছিল মূলত দীর্ঘ কবিতায়।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা কোনটি, এটি নিয়ে কোন বিতর্ক নেই.. তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা মূলত ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত মাগো ওরা বলে.. যদিও কবিতাটির প্রকৃত নাম- কোন এক মাকে, কিন্তু এটি মাগো ওরা বলে- নামে খ্যাত। ঠিক তেমনি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটি, সেটি নিয়েও কোন বিতর্ক নেই.. সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে আমি কিংবদন্তির কথা বলছি তার শ্রেষ্ঠ কাব্য।
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
এই কবিতায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলার কিংবদন্তি তুলে ধরেছেন.. তবে সেটি অন্যদের মত নয়.. আবহমান বাংলা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন গীতিকবিতার স্টাইলে.. এরপর গ্রাম বাংলা নিয়ে জীবনানন্দ এবং জসীমউদ্দীন দুটো ভিন্ন ধারা তৈরি করে ফেলেছিলেন.. অল্প কিছু কবি রবীন্দ্রনাথীয়, জীবনানন্দীয় এবং জসীমউদ্দীনীয় ধারার বাহিরে গিয়ে আবহমান বাংলা নিয়ে নিজস্ব স্টাইলে কাব্য তৈরি করতে পেরেছিলেন.. এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি আল মাহমুদ এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।
আল মাহমুদ
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
আবহমান গ্রাম বাংলাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কবি আল মাহমুদ এই তিন প্রধান ধারার বাহিরে গিয়ে নিজস্ব একটি স্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন.. যেখানে লোকজ শব্দের সুনিপুণ প্রয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব ভাষা, শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করে, নিজস্ব আঙ্গিকে, রূপকের ভাবগাম্ভীর্যে, অদ্ভুত সব চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
আর অন্যদিকে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সমসাময়িক হয়েও হেঁটেছেন ভিন্ন পথে.. তিনি অনেকটা উচ্চস্বরে শব্দের খেলায় কবিতার ভাবকে নিয়ে গেছেন ভিন্ন মাত্রায়..
তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন
অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন
পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন
তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।
তার কবিতায় শব্দের অনুরণন বিদ্যমান.. একই শব্দ এবং একই ছন্দ বারবার ফিরে আসে.. কিন্তু তার কবিতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো এই অনুরণন বিরক্তির উদ্রেক করে না.. বরং সেটি পাঠককে একটি ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। লাটিম যেমন একই বৃত্তে বারবার ঘুরে.. তার ঘূর্ণন দেখতেই আমাদের ভালো লাগে.. ঠিক তেমনি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতায় শব্দগুলো যেন একই বৃত্তে ঘুরপাক খায়.. এই ঘূর্ণন দেখতেই ভালো লাগে। অবশ্য প্রত্যেকটা লাইনে কয়েকটা শব্দ চেঞ্জ হয়.. সেগুলো একেবারে মগজে গিয়ে আঘাত করে। এটাই তার কবিতার বৈশিষ্ট্য.. এটাই তাঁর কবিতার সৌন্দর্য।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
আমি উচ্চারিত সত্যের মতো
স্বপ্নের কথা বলছি।
উনুনের আগুনে আলোকিত
একটি উজ্জ্বল জানালার কথা বলছি।
তার শব্দের পুনরাবৃত্তি এবং অনুরণন যখন পড়তে থাকি.. একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই.. মনে হয়- অর্থ বোঝার প্রয়োজন নেই.. আবৃত্তির আনন্দেই আবৃতি করতে থাকি.. এ-ই এক শব্দের খেলা।
তার কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল.. প্রত্যেকটি লাইনের এক একটি বাণী.. এক একটি উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ঠিক যেমনটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস শেষের কবিতা পড়ার সময় আমাদের অনুভূত হয়.. প্রত্যেকটি লাইন যেন এক একটি অমর উক্তি.. অমীয় বাণী।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সন্তানের জন্য মরতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ভালোবেসে যুদ্ধে যেতে পারে না।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে সূর্যকে হৃদপিন্ডে ধরে রাখতে পারে না।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি
আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি
তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল
কারণ তিনি ক্রীতদাস ছিলেন।
আমরা কি তা’র মতো কবিতার কথা বলতে পারবো,
আমরা কি তা’র মতো স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি কবিতাটি যেন শুধু বাংলার নয়.. সমসাময়িক পৃথিবীর একটি ইশতেহার.. এখানে তিনি কাব্যিক ভাষায় নিজস্ব ভঙ্গিতে তুলে এনেছেন সময়কে.. তুলে এনেছেন বৈশ্বিক রাজনীতিকে.. শ্রেণী সংগ্রাম এবং শ্রমিকের স্বপ্নকে। যদিও তিনি সব সময় কৃষকদের পক্ষে, শ্রমিকের পক্ষে, শোষিত মানুষের পক্ষে.. তারপরও অবাক লাগে- যখন দেখি হুমায়ুন আজাদের মত সমালোচক তাকে আধুনিক কবিদের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ সংকলিত আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলনে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ঠাঁই হয়নি শুধুমাত্র সরকারি চাকরি এবং স্বৈরসরকারের মন্ত্রী হওয়ার কারণে।
উল্লেখ্য যে, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে ইংরেজি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত হন.. ১৯৫৭ সালে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন.. এবং ১৯৮২ সালে সচিব হিসেবে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন.. একই বছর তৎকালীন সরকারের শ্রম ও কৃষি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন.. এবং দুই বছর মন্ত্রণালয় সামলান পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
যাই হোক- এটা একটা পুরাতন বিতর্ক.. কবিদেরকে কি কবিতা দিয়ে বিচার করব? নাকি তাদের জীবন এবং কবিতা দুটো সমন্বয় করে বিচার করব? এই বিতর্কে কবি আল মাহমুদ, ফরুক আহমেদ সহ আরো অনেক বিখ্যাত এবং প্রতিভাবান কবিকেই হুমায়ুন আজাদ তার সংকলনে থেকে বাদ দিয়েছেন.. আজও এই বিতর্কের অবসান হয় নি।
বিতর্ক বিতর্কের জায়গায় থাক.. আমরা কবিতা পড়তে থাকি.. এবং স্বাদ আস্বাদন করতে থাকি সাহিত্যের.. ডুবে যেতে থাকি কবিতার ঘোরে..
আমি স্থির লক্ষ্য মানুষের
সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা বলছি
শ্রেণীযুদ্ধের অলিন্দে
ইতিহাসের বিচরণের কথা বলছি
আমি ইতিহাস এবং স্বপ্নের কথা বলছি।
স্বপ্নের মত সত্যভাষণ ইতিহাস
ইতিহাসের আনন্দিত অভিজ্ঞান কবিতা
যে বিনিদ্র সে স্বপ্ন দেখতে পারে না
যে অসুখী সে কবিতা লিখতে পারে না।
যে উদ্গত অংকুরের মত আনন্দিত
-সে কবি।
যে সত্যের মত স্বপ্নভাবী
-সে কবি।
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।
আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।
আমি বিচলিত বর্তমান
এবং অন্তিম সংগ্রামের কথা বলছি।