নাগরিক কবি বলা হয় শামসুর রাহমানকে.. কেউ কেউ তাকে মুক্তিযুদ্ধের কবিও বলে থাকেন.. বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছদ্মনামে দুটি বিখ্যাত কবিতা তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা তুমি- লিখে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উৎসাহ প্রধানের কারণে তাকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।
শামসুর রহমানের প্রথম কবিতা সোনার বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে.. কবিতাটির নামও উনিশশো ঊনপঞ্চাস... তবে তার মেধার স্ফূরণ দেখা যায় পঞ্চাশের দশকে.. যে কারণে তাকে ৫০ দশকের প্রধান কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
প্রথম দিকে তিনি কবি জীবনানন্দ দাশকে অনুসরণ করতেন.. বিশেষ করে তার একটি বিখ্যাত কবিতা রুপালি স্নান পড়লে পাঠক এখনো কনফিউজড হয়ে যান.. এটা জীবনানন্দ দাশের কবিতা না শামসুর রাহমানের কবিতা? অবশ্য এই প্রভাব তিনি খুব দ্রুতই কাটিয়ে ওঠেন.. এবং নিজস্ব একটি স্বাতন্ত্র্য পথ তৈরি করেন।
কবিতার ক্ষেত্রে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ.. লেখার ক্ষেত্রে এমন একটি ভাষা এবং স্টাইল তৈরি করা.. যেন একটা লাইন পড়লেই বোঝা যায়- এটা অমুকের লেখা। এই কাজটি শামসুর রাহমান খুব ভালোভাবে করেছেন.. তার শব্দচয়ন, ভাষা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ ইত্যাদির এমন একটা নিজস্ব স্টাইল ছিলো, যা আর কারো সাথে মিলে না। পরবর্তীতে অন্যান্য কাব্যকর্মীরা তাকে এত বেশি অনুসরণ করেছে যে.. এখন আর আলাদা করা কঠিন হয়ে যায়।
শামসুর রহমান সারাজীবন নাগরিক আধুনিক কবিতা চর্চা করে গেছেন.. বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা এসেছে মূলত তিরিশের দশকে.. তবে তা পরিণত পর্যায় এসেছে শামসুর রাহমানের হাত ধরে।
শামসুর রহমানের চেহারায় একটা সৌম্য শান্ত ভাব ছিল.. যা তার লেখার মধ্যেও ফুটে উঠত। তার কবিতাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি.. এক ভাগে রয়েছে উচ্চকিত স্লোগানধর্মী রাজনৈতিক কবিতা.. অন্যদিকে রয়েছে শান্ত-স্নিগ্ধ শহুরে ভাষার সাহিত্য রসসমৃদ্ধ গভীর ভাবের কবিতা।
রাজনৈতিক কবিতাগুলোর কারণে শামসুর রাহমান বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন.. অবশ্য তাকে বাধ্য হয়েই অনেক সময় রাজনৈতিক কবিতা লিখতে হয়েছে.. কারণ লেখালেখি শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই- বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের বাংলা কবিতায়- তিনি এদেশের প্রধান কবি হিসেবে আখ্যায়িত হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং কবিতা সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি সভাপতিত্ব করেন.. দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে কবি সমাজের ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে তাকেই নেতৃত্ব দিতে হয়েছে.. এবং তিনি সেটি খুবই সফল ভাবে দিয়েছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় লেখা আসাদের শার্ট কিংবা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে লিখা মাওলানার টুপি অথবা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় লিখা উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ এবং বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা স্বাধীনতা তুমি এবং তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা.. ইত্যাদি বিভিন্ন রাজনৈতিক কবিতা তার সময় সচেতনতা এবং দেশ ও সমাজের প্রতি তাহার দায়বদ্ধতার প্রমান।
সময়কে তিনি শৈল্পিক রূপ দিয়ে উচ্চকিত স্বরে পরিবেশন করতে খুবই পারদর্শী ছিলেন.. সাহিত্যের এই ধারায় তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশে তরুণ কবিদের অনেকেই করতে চেয়েছে পরবর্তীতে... এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাফল্য পেয়েছে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ... তার রাজনৈতিক কবিতাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে আসে কবিতা পাঠের আসরে।
শামসুর রাহমান তার পরবর্তী কবিদের এত বেশি প্রভাবিত করেছিলেন যে- সেটি বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি... যে কারণে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত প্রধান কবি। আল মাহমুদের সাথে তার একটা দ্বৈরথ যদিও সবসময় চলমান ছিল.. এবং অনেক সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে- সাহিত্যমানের দিক দিয়ে আল মাহমুদের লেখনি শামসুর রাহমানের চেয়ে এগিয়ে.. তারপরেও শামসুর রাহমানের ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, প্রভাব এবং নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যবোধের কারণে জীবিতাবস্থায় সবসময়ই তিনি আল মাহমুদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন।
যদিও আল মাহমুদের সাথে তার একটা দ্বৈরথ সর্বদা চলমান ছিল... কিন্তু তার মানসিক উদারতার কারণে তিনি আল মাহমুদকে পর্যন্ত বুকে টেনে নিতে কখনও দ্বিধা করেন নি.. গনকণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদনার কারণে আল মাহমুদ জেল খাটতে হয়.. সেই সময় জেলখানায় কবি আল মাহমুদকে দেখতে গিয়েছিলেন শামসুর রাহমান.. যেটি আল মাহমুদ পরবর্তী বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বার বার উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশে শামসুর রাহমান পরবর্তী যত বিখ্যাত কবি আছেন- প্রায় প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনোভাবে শামসুর রাহমান দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। কোন কবি যখন অর্থাভাবে পড়তেন.. কিংবা চাকরি খুঁজতেন.. তখন তাদের প্রথম এবং নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল ছিল শামসুর রাহমান।
কবি শামসুর রাহমান সামান্য সুপারিশ করলে তাদের চাকরি হয়ে যেত.. এভাবে অনেক কবিকে তিনি বিভিন্ন পত্রিকা কিংবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেতে সহযোগিতা করেছেন.. তার দরজা সব সময় সব কবিদের জন্য খোলা ছিল.. এবং তার বাড়িটি ছিল আধুনিক বাংলা কবিদের একটি সম্মেলন কেন্দ্র।
বাংলা সাহিত্যে শামসুর রহমানের মতো প্রভাবশালী কবি পরবর্তীতে আর কেউ আসেনি। কবিদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টিতে তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
উল্লেখ্য যে...
কবি শামসুর রাহমান একজন প্রচন্ড বুদ্ধিদীপ্ত কবিও ছিলেন... তিনি উপমা এবং ঘটনার অন্তরালে এমনভাবে সমসাময়িক বিষয় তুলে ধরতেন যে- শাসকশ্রেণী যদিও বুঝতে পারত তিনি কি ইঙ্গিত করেছেন, কিন্তু তাকে সরাসরি দোষারোপ করতে পারত না..
যেমন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশে যখন অস্বাভাবিক নিরবতা বিরাজ করছে.. কিছু সুবিধাবাদী লাইন ধরেছে গণভবনে.. আর কবি সমাজে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা.. সেই সেই অন্ধকার সময়ে আর সবাই চুপ থাকলেও শামসুর রাহমান তো চুপ থাকতে পারেন না। তিনি সরাসরি বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে না লিখে পুরাণিক চরিত্র আগামেমনন-কে নিয়ে লিখলেন আরেকটি বিখ্যাত কবিতা:
নিহত জনক আগামেমনন কবরে শায়িত আজ
একইভাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় লিখেছেন: উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ... এমন ভাবে তিনি বর্ণনা এনেছেন- শাসকশ্রেণী তাকে ঘাটাতে পারে নি.. যদিও সে সময় অনেক কবিই ক্যান্টনমেন্ট থেকে ডাক পেয়েছিলেন.. মিলিটারির সামনে বসে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে তাদের লেখার.. শামসুর রাহমানকে ডাকার মত প্রসঙ্গ স্বৈরাচার সরকার খুঁজে পায়নি।
স্বৈরাচার প্রসঙ্গ যখন আসলো.. আরেকটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য.. সামরিক সরকারের প্রধান হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ একজন সৌখিন কবি ছিলেন। যেহেতু তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট.. ক্ষমতার কারণে তাঁর কবিতা পত্রিকাগুলো প্রথম পাতায় ছাপাতে বাধ্য হতো। এ সময় এরশাদ সরকার তোষামোদি কবিদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিত। এইসবের প্রতিবাদে বেসরকারিভাবে বাংলাদেশের কবিগন জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করে.. যার নেতৃত্বে ছিলেন শামসুর রাহমান।