সমুদ্র পথে বিদেশ ভ্রমণ

নৌবাহিনীর পনর মাস ট্রেনিং শেষে কাপ্তাই এর বা নৌ জা শহিদ মোয়াজ্জেম থেকে ডিসেম্বর ১৯৮৭ইং সাল এ প্রথম জাহাজ এর চাকরি করার জন্য বা নৌ জা আবুবক এ বদলি করা হয়। ফ্রিগেট এ বদলি পাওয়া একটি সৌভাগ্যের ব্যপার ছিলো,তখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বড় জাহাজ ছিলো তিন ফ্রিগেট। এর অন্য কোন কারন যা ই থাকুক না কেন প্রচুর ইকুইপমেন্ট থাকার কারনে একজন সৈনিক তার
কর্মজীবনের অনেক কিছুই এখান থেকে শিক্ষা নিতে পারে। আপনি যত বই ই পড়েন না কেন যদি প্রাক্টিক্যাল কাজ না করেন তাহলে কোন লাভ হয় না।বড় জাহাজে চাকুরী করলে অনেক সিনিয়র, অনেক ইকুইপমেন্ট থাকার কারনে এখানে মেন্টেইনেন্স এর কাজ করা বা যে কোন শিক্ষা অনেক সহজ হয়ে থাকে।যাই হোক সেটা আরেক প্রসংগ।
১৯৮৯ইং সালে দুইটি ফ্রিগেট-আবু বকর ও ওমর ফারুক সার্ক ভুক্ত তিনটি দেশ শুভেচ্ছা সফরে যাবে।

images (24).jpeg
PIC SOURCE
BNS Umor Faruk.jpg
(PIC-MY CLICK)
দেশ গুলো হচ্ছে ভারত,পাকিস্তান ও মালদ্বীপ।ভারতের কোচিন বন্দর,পাকিস্তানের করাচি এবং মালদ্বীপ এর মালেতে স্থান নির্বাচন করে দেয়া হয়েছে। পুরাতন যারা আগে ২/১ বার বিদেশে গিয়েছে তাদেরকে অস্থায়ী বদলি করে নতুন কিছু সেনা জাহাজে বদলী আসলো। কিছু স্পেশাল জনবল, খেলোয়াড়, মিউজিশিয়ান ও ডকইয়ার্ড স্টাফ জাহাজে যোগ করা হয়েছে।
রসদ,জ্বালানি ও পানি ফুল লোড করে দেওয়া হয়েছে। আবার কোচিন বন্দরে নেওয়া হবে।

করনফুলীতে জোয়ার শুরু হলে বিভিন্ন ফর্মালিটিস পালন করে,বিউগল বাজিয়ে আমাদের জাহাজ দুটি জেটি ত্যাগ করে প্রথমে ভারতের কোচিন বন্দরের উদ্দেশ্যে।

IMG_20220705_215506.jpg
PIC GOOGLE MAP

পতেংগা মোহনা পেরিয়ে প্রচন্ড উৎফুল্লচিত্তে জাহাজ চলছে। কুতুবদিয়া লাইট হাউজ থেকে উত্তাল বঙ্গোপসাগর এর নীল জলরাশির বুক চিড়ে জাহাজ ছুটে চলছে। সাথে একের পর এক সী এক্সারসাইজ এর অর্ডার জারি হচ্ছে।

sea exercise.jpg
এই ছবিটি গভীর সমুদ্রে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে মানুষ ও রসদ পারাপারের সময়ের।

আনন্দের মাঝে কস্টকে আর কস্ট মনে হয় না। বঙ্গপসাগরে দক্ষিন পশ্চিম কর্নারের দিকে জাহাজ চালানো মানেই সী সিক এর জন্য প্রস্তুত থাকা। সাগরের মাথা যতই ঠিক থাকুক না কেন জাহাজের রোলিং পিচিং এ আপনাকে একটু হলেও চুম্বন করবেই। কত ঘন্টা লেগেছিলো এখন আর মনে নেই। জাহাজের গতি সর্বউচ্চ ১৮ নটিক্যাল মাইল হলেও ১০/১২ নটিক্যাল মাইল এর বেশি তো আর চালানো হয় না। বঙ্গপোসাগর এর ঘোলা পানির অংশ পেরিয়ে যখন নীল জলরাশিতে জাহাজ চলছে হঠাৎ সবার চোখে পড়লো ডলফিনেরা আমাদের সাথী হয়েছে।যেনো স্কট করে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজকে।

ঠিক তেমনই একটি ভিডিও আপনাদের বুঝার জন্য দিলাম।
তারা যেনো জাহাজের গতি ক্যাল্কুলেট করেই চলছে। নিজের চোখে না দেখলে ঠিক এর সৌন্দর্যটা বুঝার উপায় নাই। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। দূরে আকাশ মিলেছে সাগরের বুকে। সাগরের নিছ থেকে সূর্য উঠে আবার সাগরেই ডুবে।

Akhter uz Zaman.jpg

কখনো হয়তোবা দেখতে পাই অনেক দূরে একটি বানিজ্যিক জাহাজ চলে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন-ক্যাপ্টেন এর সাথে বেতার যন্ত্রে শুভেচ্ছা বিনিময় করে যাচ্ছে। এক্সারসাইজ,খাও,ঘুমাও আর আপারডেকে বসে বসে সাগরের বিশালতা উপভোগ করতে করতে এক সময় ব্রডকাস্টিং যন্রে শুনতে পেলাম আমরা ভারত মহাসাগর এ প্রবেশ করেছি।
শ্রীলঙ্কাকে ডানে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। দূরে পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। শ্রীলঙ্কা নৌবাহিনীর একটি জাহাজ আমাদের পাস দিয়ে সেলুট করে অতিক্রম করে গেল। শ্রীলঙ্কার জলসীমা অতিক্রম করে আমরা আরব সাগরে ভারতে জলসীমায় প্রবেশ করেছি।
কেরালা প্রদেশের কোচি বা কোচিন বন্দর উপকূল এ পৌছার পর ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি ফ্রিগেট আমাদের জাহাজকে গার্ড অফ অনার দিয়ে রিসিভ করে।

IMG_20220707_160353.jpg

Akhter uz Zaman, kochin port.jpg

এই ছবিটি কোচিন বন্দরে প্রবেশ এর সময়।

মারচেন্ট পোর্টে আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত বার্থে আমাদের জাহাজ কে বাধা হয়। জানিয়ে দেওয়া হয় আমরা এখানে দুইদিন দুইরাত অবস্থান করবো। এর মাঝে নেভাল বেইজ পরিদর্শন,দুই দেশের মাঝে বাস্কেটবল খেলা, প্রীতিভোজ এ অংশ গ্রহনের জন্য আমাদের যাওয়া,আবার তারা আমাদের জাহাজে আসা। এরই ফাকে ফাকে দলে দলে ভাগ করে শহর দেখতে লিবার্টি যাওয়া। লিভারটি হচ্ছে কিছু সময়ের জন্য জাহাজের বাইরে ঘুরতে যাওয়া।
কেরালাতে তখন যে বিষয়টি আমাদের সবার ভালো লেগেছে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই মালায়েলাম ভাষা না হয় ইংরেজিতে কথা বলেতে পারে। হিন্দি তেমন কেউ বুঝে না বা বলতেও পারে না। ছয় ঘন্টার জন্য লিবার্টি পেয়ে কোথায় যাবো ভাবতে ভাবতেই সময় পেরিয়ে গেছে। না চিনলে যা হয়।

Akhter uz zaman, kochin.jpg

এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে যার যা প্রয়োজন কেনা কাটা করে জাহাজে ফিরে আসি।টেরই পাইনি দুই দিন কিভাবে চলে গেল। কেউ কেউ বলতে লাগলো জাহাজ মুম্বাই হয়ে করাচি যাবে।পরে জানা গেল পারমিশন পাওয়া যায়নি।কেরালর অরিজিনাল সীবিচের দূরত্বের কারনে যাওয়া হয়নি।সবাই বল্লো ওটা নাকি খুবই সুন্দর একটি বীচ। তাই মনের কস্ট মনেই রয়ে গেল। সত্যি বলতে ২৩ বছর নেভীতে চাকুরী করে এখন আর সাগর বা সাগর তীর আমাকে টানে না। টানে না পাহাড়। পাহাড়ে পনের মাস উঠানামা করে সেটার প্রতিও আকর্ষণ হারিয়ে গেছে।

আমাদের পরবর্তী যাত্রা পাকিস্তানের করাচি বন্দর। বিদায় জানালো ভারতীয় নেভী সেনারা। গারড অফ অনার দিয়ে পোর্ট থেকে সাগর মোহনায় নিয়ে আসলো বিদায় দিতে একটি ভারতীয় নৌবাহিনীর ফ্রিগেট।

kochin to Karachi.jpg
(PIC-GOOLE MAPE)
কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে ভারতের ফ্রিগেট সেলুট দিয়ে বিদায় নিলো। আমাদের জাহাজ দুইটি এগিয়ে চলছে আরব সাগরের বুক চিরে ভারতীয় উপকূল দিয়ে। সাগরের বুকে ছোট ছোট নৌকায় জেলেরা মাছ ধরছে। স্বচ্ছ পানি উত্তালতা নেই। মনে হলো পুকুরের পানিতে জাহাজ চলছে।দীর্ঘ উপকূল পাড়ি দিয়ে আমরা যখন পাকিস্তানের জলসীমায় রাত আটটা বা নয়টা,রাতে আর পোর্ট এ প্রবেশ না করে আউটার এংকরেজ এ রাত কাটাতে হয়।পরদিন সকালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর দুটি ডেস্ট্রয়ার আমাদেরকে স্বাগতম জানায় এবং আমাদের জাহাজকে করাচি সিভিল পোর্ট এ গারড দিয়ে নিয়ে যায়।
কোচিন এর মতোই এখানের রুটিন দিয়ে দেওয়া হয়। কেউ নেভীর ঘাটি,জাহাজ পরিদর্শন ও প্রীতিভোজে যাবে,কেউ ডিউটিতে থাকবে,কেউ লিবার্টি তে যাবে। আবার পাকিস্তান নেভীর সেনারাও আমাদের জাহাজ দেখতে আসবে ও প্রীতিভোজে অংশ নিবে। পাকিস্তান নেভীর সেনারা আমাদের ফ্রিগেট দেখে অবাক হয়ে গেছে। কত বছর হলো বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেল,এরই মাঝে এতো বড় ফ্রিগেট আমাদের।তারা খুব আফসোস করলো, একসাথে থাকলে আমরা আরো কত এগিয়ে যেতে পারতাম!আমরা সবাই ভাই ভাই।অনেক কথা হলো।বাইরে গিয়ে কেনা কাটা হলো প্রচুর।কাপড়,ফ্যান সহ যার যা প্রয়োজন। পাকিস্তানের একটি খাবার বড় সাইজের চাপাতি আর গরুর মাংস ভূনা খেয়ে শত আইটেম মসলা দিয়ে পান খেতে কেউ ভুল করেনি। আদি জাতি ভাই হিসাবে মারকেটে সবাই যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছে।
তিনদিন ছিলাম করাচিতে।একদিন বের হতে পেরেছি আট ঘন্টার জন্য। ঘুরে দেখার সময় পাইনি। অপূর্ণতা নিয়েই ফিরে আসলাম। বিদায় পাকিস্তান।

যাত্রা এবার মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে। করাচি পোর্ট ছেড়ে বের হওয়ার পর দেখি আরব সাগর অনেকটাই মাতাল। বেশ বড় বড় ঢেউ।

koraci to muldip.jpg
(PIC-GOOGLE MAP)
চলা শুরু দূরবার গতিতে।বলা যায় সোজা পথ।মালদ্বীপ এ অবস্থান একদিনের।বার ছিলো মনে আছে শুক্রবার। ডিউটি ছিলো বলে জুম্মার নামাজ পড়তে যেতে পারিনি।

muldip.jpg
(PIC-MY CLICK)
বিকাল বেলা দুই ঘন্টার জন্য বাইরে যেতে দিয়েছে।আলাদা ইঞ্জিন বোটে করে স্থলে যেতে হয়েছে। এতোটাই স্বচ্ছ পানি যে তলদেশের বিভিন্ন রং বেরং এর হাজারো মাছ জাহাজ থেকেই দেখা যায়। অদ্ভুত সৌন্দয সাগর তলের এলাকা। বাংলাদেশের অনেককেই পাওয়া গেলো সেখানে,কেউ দালালদের খপ্পরে পড়ে এখানে এসে আর কোথাও যেতে পারছে না।কেউ নিজেই এসেছে ব্যবসা করছে। প্রবাল এর তৈরী দ্বীপ এটি। টুরিস্ট এবং মাছ ধরা এখানকার মানুষের প্রধান পেশা। প্রায় সবাই মুসলমান।

maldives-20220305094628.jpg
(PIC SOURCE)
১১০০শতটির উপর ছোট বড় দ্বীপ আছে এই দেশে।এক একটি দ্বীপ এক এক নামে।এক একটি একটি আলাদা টুরিস্ট পয়েন্ট।

ঘুরে-আসুন-মালদ্বীপ-২-1068x534.jpg
(PIC SOURSE)
সেখানের ছেলে মেয়েদের রং শ্যামলা এবং মেয়েরা বেটে। একটি দ্বীপ এ তাদের বিমানবন্দর। ইন্টারনেট ডুকে দেখতে পাবেন কতটা সুন্দর এই দ্বীপদেশটি।অনেকটা আমাদের সেন্টমারটিন দ্বীপের মতোই।
সেখান থেকে জিজেল নেওয়া হলো জাহাজের জন্য।
রাতেই আবার নোংগর তুলে রওনা দিলাম দেশের উদ্দেশ্যে। তখন ক্যামেরা ছিলো খুব কম মানুষের হাতে। গুনে গুনে ছবি তুলতে হতো।
Cannon auto focus 35mm Camera.jpeg
(PIC SOURCE)
তারপর কাগজে প্রিন্ট করে দেখতে হতো।তাই হৃদয়ে আকা সৃতিই মানুষের সব কিছু ছিলো।এখন গেলে সৃতির পাতা সম্পূর্ণ রঙিন থাকতো।
ইচ্ছে হয় আবার মালদ্বীপ এ ঘুরে আসি।
চলতে চলতে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে নিজেদের উত্তাল বংগপোসাগর এ ডুকে গেলাম।
নিজের জন্মভূমি। নিজের ঠিকানায়।চট্টগ্রাম নেভাল জেটিতে।
আগস্ট ১৯৮৯ সাল এ বিএনএস আবু বকর থেকে বদলি হয়ে গেলাম সেই সময়ের একমাত্র ওয়েল টেংকার খান জাহান আলীতে।

সবাই সময়,সুযোগ ও সামরথ থাকলে দেশে ও বিদেশে ঘুরে আসুন। বুঝতে পারবেন আল্লাহ কত সুন্দর করে পৃথিবীটাকে তৈরী করেছেন।
ভালো থাকুন।
সুস্থ ও সুন্দর থাকুন।

আখতার উজ জামান
তারিখঃ ০৯জুলাই ২০২২ ইং
সময়ঃ ১২-২৬এ.এম

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now