'আচ্ছা ভাই বলতো,মানুষ এভাবে বদলে যায় কেনো? আমি তো ওর সাথে কখনোই এমন করিনি যাতে ওর খারাপ লাগে! নিজে সমস্যায় ভুগেছি,তবুও! ও তো আমাকে খুব ভালোবাসতো।আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসতো!আমি তো ওর হাসি দেখেই ওকে এত পছন্দ করতাম!'
ভরদুপুর। বসে আছি গ্রামের একটা বড়সড় পুকুরপাড়ের গাছের নিচে। ভালোই বাতাস দিচ্ছে। বহুদিন পর এসেছি গ্রামে,হঠাৎই মুহিব ভাইয়ের সাথে দেখা।
'শোভন জানিস,যেদিন অর্পার সাথে আমার কথা হয়েছিলো আমি একটা কথাও বলতে পারি নি। আমি তো কারো সাথে সেভাবে কথা বলতে পারতাম না। অর্পা নিজেই কথা বলতে এসেছিলো। ওর সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পরে আমি কথা বলতে শিখেছিলাম।' আমার একবার ইচ্ছে হয় বলি, মুহিব ভাই আপনি যা ভাবছেন তা আসলে ভুল। অর্পা আপনাকে ভালোবাসে নি। বরঞ্চ আপনিই বেসেছেন। একা। এটা আপনার দোষ নয়, আপনার সরলতা। আর মেয়েরা বন্ধু হলেই যে ভালোবেসে ফেলবে এমনটিও না।
কিন্তু থাক। হয়তো ভাই আরো কষ্ট পাবেন। 'মুহিব ভাই,চলেন আজকে আপনার বাসায় যাই। খালাম্মার হাতের রান্না বহুদিন খাওয়া হয় না..'
আমি একটু একা ধরনের মানুষ।এজন্য আমার হাতে অফুরন্ত সময়,একা একা যেখানে খুশি যাই,হেঁটে বেড়াই।পূর্নিমা রাতে গ্রামের পরিবেশ যে এত সুন্দর হয় আমার জানা ছিলো না।আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম মুহিব ভাইয়ের কথা।উনি কিন্তু সত্যিই ভালোবেসেছিলেন অর্পাকে।অর্পাও হয়তো তাকে পছন্দ করতো ।কিন্তু কোনও এক কারণে এখন এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে।হয়তো একঘেয়ে হয়ে গেছেন! মানুষের মন সহজে পড়া যায়, কিন্তু পদ্ধতিটা খুব কঠিন। সেটা হলো চোখ। একজন মানুষ যত কিছুই করার চেষ্টা করুক না কেন, তার যাবতীয় কথা চোখেই প্রকাশ পায়। মুহিব ভাই হয়তো সেটা পড়তে পারেন নি, কিংবা চেষ্টা করেন নি!
অনামিকার ফোন।'শোভন তুমি এমন কেন?সারাদিন তোমাকে ফোনে পাইনি।কি করছিলে তুমি?আচ্ছা তুমি নাহয় আমার কথা ভাবো না,আমি তো তোমার কথা ভাবি,তাইনা?'
কোমল,ঠান্ডা এবং অভিমানী কন্ঠ।আমি হেসে ফেললাম।এত সুন্দর মেয়েটার সাথে হয়তোবা আমার কোনদিন পরিচয়ই হতো না।কলেজ লাইফে আমি সবসময় একা থাকতাম।ক্লাসের এক পাশে আমাদের পুকুর ছিলো,তার পাশে ছিলো পাকুড়গাছ।আমি প্রতিদিন আগে এসে ওখানেই বসতাম।এক কোনায়,জানালার পাশে।আমার মন পড়ে থাকতো পুকুরেই।আমি ক্লাসে কারো সাথে খুব একটা কথাও বলতাম না।টিফিনের সময় সবার আড়ালে খাবার খেতাম,খেয়েই লাইব্রেরিতে ছুটতাম।এই ছিলো আমার কলেজ প্রাত্যহিক রুটিন।
এসময়ে রুটিনে একদিন বাধা পড়ে।খাবার খেতে গিয়েছিলাম,সেসময় আমাকে বেশকয়েকজন ছেলেমেয়ে আটকে ধরে নিয়ে যায়,মাঠে বসে গল্প করবে বলে।আর এই দলের নেতৃত্বে ছিলো অনামিকা।ও খুব হাসিখুশি,চঞ্চল স্বভাবের একটা মেয়ে ছিলো।সহজেই কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে না পারলেও,ও খুব সামাজিক ছিলো।আর আমি ছিলাম একেবারে তার উল্টো।
যাই হোক,বাকিদের সাথে তো আমার আচরণ আগের মতোই থেকে যায়।আমি ওদের সাথে ফ্রি ভাবে মিশতে পারিনি।কিন্তু কিভাবে যেন অনামিকার সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।আমি যদিও এর আগে ওকে কখনোই লক্ষ্য করি নি,তবে এই প্রথম ওর প্রতি আমার একটা ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করে।আমাদের প্রায়ই কথা হতো তখন।কিন্তু আমি ওকে কিছু বলতে পারিনি,কারণ আমি খুবই কম কথা বলতাম।পুরো সময়টাই ও কথা বলে যেত।কিন্তু আমি মাঝে মাঝে ওর দিকে ঘাড় কাত করে একমনে চেয়ে থাকতাম!আবার ও যখন আমার দিকে তাকাতো তখন হকচকিয়ে অন্যদিকে তাকাতাম!তখনও জানতাম না,ও বুঝতো কি না!আর বুঝলেও বিষয়টাকে কিভাবে নিতো।
আমাদের কলেজের মাঠে একপ্রান্তে একটা গাছ ছিলো।আমি প্রায়দিনই সবার আগে কলেজে যেতাম ঐ বিশেষ সিটটা দখল করার জন্য।যথারীতি একদিন গিয়ে দেখি,অনামিকা ক্লাসে একা একা বসে আছে।আমি ভাবলাম একবার বলি,'আজ হঠাৎ এত আগে এলি যে?' কিন্তু পরক্ষণেই সে চিন্তা বাদ দিয়ে আমি আমার জায়গায় বসে পুকুর দেখতে লাগলাম।এমন সময় অনামিকা আমাকে বললো,'শোভন শোন,আজ টিফিনে একটু বড়গাছের নিচে আসবি তো!'
আমাদের টিফিনের আগে চারটে ক্লাস হতো।আমি একটা ক্লাসও করতে পারিনি সেদিন।শুধু মনে হচ্ছিলো অনামিকা কেন ডাকলো?কি বলবে?বন্ধুত্ব ভেঙে দেবে?
শেষে গেলাম।কিছুক্ষণ পরে অনামিকা এসে বললো,'আজ খুব গরম তাই না রে?'
'হ্যাঁ।কি যেন বলবি বলছিলি?'
'ওহ হ্যাঁ।শোন না শোভন..'
সেদিন আমাকে অনামিকা প্রেম নিবেদন করেছিলো।সেদিনই শুরু।
এরপর কতদিন বড়গাছের তলায় একসাথে বসে পাখির উড়ে যাওয়া দেখেছি,ক্লাসে সবার আগে এসে ওর হাতে চিঠি গুঁজে দিয়েছি,বর্ষায় কলেজ থেকে ফেরার পথা হাত ছড়ে যাওয়ার বিনিময়ে কদমফুল পেড়ে দিয়েছি,ছুটির দিনের বৃষ্টিতে কবিতা শুনিয়েছি,চৈত্রের অলস দুপুরে তাকে গান শুনিয়েছি,আরো কত কি..
একবার কলেজের ছুটি হবার ঠিক আগে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। আমি আবার ততদিনে একটু-আধটু বই পড়ে পড়ে বুঝে ফেলেছি বৃষ্টি হলো রোমান্টিসিজমের চূড়ান্ত।আর যায় কোথায়! আমার বইখাতা রেইনকোটে মুড়ে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরছি। আহা,কি আনন্দ! বৃষ্টির ফোঁটাগুলো চুইয়ে চিবুক বেয়ে পড়ছে,আর রাস্তায় জমা পানিগুলো জুতোর ভেতরে৷ ঢুকে ছোটখাট জলাশয় বানিয়ে ফেলেছে! হঠাৎ শুনি পেছন থেকে অনামিকা চিৎকার করতে করতে হেলে দুলে দৌড়ে আসছে! দেখে বেশ হাসি পেল, কিন্তু তার মুখ দেখে হাসার সাহস হলো না। সারাটা রাস্তা সে কৈফিয়ত চাইতে চাইতে গেল, কেন তাকে রেখে আমি বৃষ্টিবিলাসে নামলাম। অবশেষে রাস্তার পাশে অনাদরে বড় হওয়া কদমগাছের ফুল দিয়ে তাকে থামানো গেল!
'শোভন তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?আমি জানি আমার প্রতি তোমার কোন আগ্রহ নেই।কিন্ত তাই বলে তুমি আমার কথার উত্তর পর্যন্ত দিচ্ছো না।কেন?বলো,কেন?'
আমি আরেক দফায় হাসলাম।ওর কন্ঠস্বরটা এমনিই অনেক কোমল আর শান্ত।এতক্ষণেও কিভাবে কান্না আটকে রেখেছে কে জানে?
এবারে বলতে শুরু করলাম-
"যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব
আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।" (রুদ্র গোস্বামী)
'অনামি,কতদিন তোমায় দেখি না?তোমার চশমাপরা দাগটায় কতদিন ছুঁয়ে দেই না বলো?'
এবার সে কাঁদতে শুরু করেছে।আমি হাসছি,চাঁদ হাসছে।কিছুক্ষণ পর সেও হাসবে।প্রকৃতি ভরে উঠবে এক অস্বাভাবিক নমনীয় ভালোবাসায়!