ভয়ানক একটি ঝড়ের রাত ও তার কিছু ভয়ঙ্কর অনুভুতি
ঠিক এমন গ্রীষ্মকালে টাক ফাটা রোদে হঠাৎ বিকালের দিকে উত্তর পশ্চিম দিক হতে কালো মেঘ ধেয়ে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে। সেই সময় আমি ছিলাম একদম ছোট্ট। বলতে গেলে ৫ বছরের মতো। দিনটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেই দিন প্রচন্ড গরম পড়েছিল। সেই দিনই আমার নানু বলেছিলো আজকে একটা ঝড় হবে। সারাটাদিন আকাশে কোনো মেঘ দেখা যায় নি। কিন্তু বিকাল হতে না হতেই আকাশে কালো মেঘের আনা গুনা শুরু হয়। সাথে ছিল প্রচন্ড বাতাশ। এই বাতাস দেখে আমার সব বন্ধুরা আম কুড়াতে বের হয়ে যায়। কিন্তু আমি বাধ্য হয়ে ঘরে বসে থাকি। কিন্তু তারা বেশিক্ষন আমি কুড়াতে পারেনি। তারা ঠিক ২ মিনিট পর তাদের ঘরে চলে যায়। তখন থেকেই একটু একটু করে ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়।
ঝড় শুরু হওয়ার আগেই কারেন্ট চলে গিয়েছিলো। সেই সময় আমাদের বিদ্যুতিক ব্যবস্থা ততটা উন্নত ছিলনা। ঝড় শুরু হওয়ার সময় নানু দোকান থেকে দুইটা মোমবাতি কিনে আনে। কালো মেঘের কারণে পুরো রাত হয়ে গিয়েছে। তাই আম্মু একটা মোমবাতি ধরিয়ে দিয়েছে। তখন প্রায় পুরোপুরি ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে। তখনি হঠাৎ করে একটি বিকট শব্দে আমগাছটার ডাল ভেঙে পড়লো। পাশেই কোথাও যেন বাজ পড়েছে ! মোম প্রায় শেষের দিকে তাই আমরা দেরি না করে খেতে বসে গেলাম। কারো যেন ভাত গলা দিয়ে নামছিলোনা। সবাই ভয় পেয়ে আছে। তাও জোর করে খেয়ে সবাই উঠে পড়লো।
তখন হঠাৎ করে দেখি আমাদের বাড়ির চালটা খুঁটি থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। তখনি নানু চিৎকার করে বলল "কেউ ধরো" । তখন আমার আব্বু , মামা আর নানা ভাই মিলে সেটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঝড়ের সাথে কি আর পেরে উঠা যায় ? অনেক চেষ্টার পরও সেটা খুলে যাচ্ছিলো। তখন সবাই কান্না করছে সাথে আমিও। তখন একটা একটা করে মনে হচ্ছিলো সব চালের খুঁটি গুলো খুলে যাচ্ছে। কিচ্ছুক্ষন পর পুরো চালটা উড়িয়ে নিয়ে গেল। তখন আম্মু ও নানু চিৎকার করতে থাকে। মামা বলে সবাই খাটের নিচে আশ্রয় নাও। নাহলে কোনো কিছু আঘাত আনতে পারে। সবাই খাটের নিচে আশ্রয় নেয়। আমি আর কিছু বলতে পারিনা। আমি হয়তোবা অজ্ঞেন হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক ছোট বেলার ঘটনা তাই সঠিক মনে নেই।
সকাল বেলা আমার চোখ খুলে সূর্যের আলোয়। সূর্যের আলো এসে আমার চোখে পরে । তখন দেখি সবাই উঠে আমাদের ভাঙা ঘরকে পরিষ্কার করছে। পুরো ঘর লন্ড - ভন্ড হয়ে গিয়েছে। একটা চাল আমগাছের সাথে লেগে রয়েছে। পাশেই অনেক গুলো মুরগি আর হাঁস মরে পরে রয়েছে। আমি তখন বুঝতে পেরেছিমা প্রকৃতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। তারপর আমি সেইখান থেকে উঠে একটু আসে পাশের পরিস্থিতি দেখতে যাই। দেখি আমরা শুধু একা না অনেকের বাড়ির অস্তিত্ত বিলীন হয়ে গেছে। সেদিন বিকালে খবর আসে সেই দিন রাতের ঝরে ৪ জন মারা গিয়েছে। আমি শুনে শুকাহত হয়ে গিয়েছিমা। আল্লাহর কাছে অনেক শোকরিয়া যে আমাদের পরিবারের কারো কিছু হয় নি।
সেই সময় আমার বয়স অনেক কম ছিল। কিন্তু সেই রাতের ভয়াবহতা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা ছিল। তাই হয়তোবা সেই দিনটা আমাদের জীবন থেকে মুছবেনা । কালবৈশাখী ঝড় আমাদের ঢাকায়ও হয় কিন্তু কোনো রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয় না। আজ যদিও আমাদের ঘর আগের মতো নেই । ঝড় আসলেও কিছু হবে না। কিন্তু আগের সেই ঘরের লন্ড ভন্ডটা আমাদের "জীবনের কালোরাত" নাম আখ্যায়িত হয়ে থাকবে।
আগে শুধু কালবৈশাখীঝড়ের নাম শুনেছি। কিন্তু তখন দেখেও ছিলাম কালবৈশাখী ঝড় কেমন। আমি চাইনা আরো কারো জীবনে এইরকম অভিজ্ঞতা হোক। অনেক বছর কেটে গেছে কিন্তু সেই রাতের ভয়াবহতা আমার মনে আজো রয়েগেছে। সে রাতের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে। সে দিনের ঝড়ের রাতে আমার মনে হয়েছিল প্রকৃতির বুকে মানুষ কতটা অসহায়।
Image source -: Pixabay