ছোটবেলার কথা এখনোও মনে আছে৷ প্রতিদিন ৮-১০ ঘন্টার লোডশেডিং। দিনের বেলা সারাদিন বাইরে বাইরে থাকতাম। কারেন্ট আছে কি নেই, তা নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিল না৷ কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই কেরোসিন তেলের কুপি, হারিকেন কিংবা মোমবাতি, যখন যা থাকতো, তা নিয়েই প্রস্তুত হয়ে যেতাম। কারণ প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পরই লোডশেডিং শুরু হয়ে যেত। টানা ২-৩ ঘন্টা পর্যন্ত কারেন্ট থাকতো না৷ শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা, সবসময় একই অবস্থা৷
গত ৯-১০ বছরে বিদ্যুতের দিক দিয়ে বাংলাদেশে অনেক উন্নতি হয়েছে৷ একসময় প্রতিদিন ১০-১২ ঘন্টা লোডশেডিং এ কাটানো আমরা ২০১৩-১৪ সালের পর থেকে তেমন একটা লোডশেডিং পাই নি৷ বিশেষ করে গত ৩-৪ বছরে তো লোডশেডিং কী, সেটাই ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু গ্রামে কাটানো গত দেড় সপ্তাহে লোডশেডিং এর সেই পুরানো স্বাদ যেন আবারও ফিরে পেয়েছিলাম।
বিশ্বব্যাপি জ্বালানি সংকটের রেশ আমাদের বাংলাদেশেও পড়েছে৷ গত প্রায় এক দেড় মাস ধরে পুরো দেশেই লোফশেডিং এর মাত্রা ভয়াবহ৷ প্রতিদিন ৩-৪ ঘন্টার লোডশেডিং। কুমিল্লায় অবশ্য এর রেশ এখনোও পড়ে নি৷ কুমিল্লার বিদ্যুৎ সংযোগ ভারতের ত্রিপুরার সাথে সংযুক্তি থাকার কারণে হয়তো এখানে লোডশেডিং এর মাত্রা এখনো এতটা বেশি হয় নি৷
তবে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে যে মানুষ কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে, তা সোশ্যাল মিডিয়া ঘুরাঘুরি করলেই বুঝা যাচ্ছে৷ এমনিতেই এবার বাংলাদেশের তাপমাত্রা অনেক বেশি। গরমের মাত্রা অন্যান্য বারের চেয়ে তুলনামূলক বেশি৷ এই অবস্থায় লোডশেডিং এর কবলে পড়লে কষ্ট হয়ে যায় অনেক৷
তবে ছোটবেলায় লোডশেডিং এর সময় আমার খুব বেশি একটা খারাপ লাগতো না৷ শুধু আমি না, আমার সমবয়সী যারা ছিল, তাদের সকলের জন্যই লোফশেডিং এর মুহুর্তগুলো অনেকে মজার ছিল৷ এমনিতে বিকেল বেলায় খেলাধুলা শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসা আমাদের জন্য একপ্রকার অলিখিত নিয়ম ছিল৷ সেই নিয়ম ভাঙার মতো সাহস আমার কখনোই হয় নি৷ কিন্তু পড়তে বসার পর যখন কারেন্ট চলে যেত, তখন আমরা ছোটরা হইহই করতে করতে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম।
বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতগুলোতে বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য কোনো বাধা ছিল না৷ দল বেঁধে সবাই বের হয়ে যেতাম৷ আমাদের দেখাদেখি বড়রাও বের হয়ে যেত৷ আমাদের বাসার সামনেই ছোট একটা খেলার মাঠ ছিল। বড়রা মাঠের চারপাশে বসে গল্পগুজব করত৷ তবে তাদের গল্পের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই রাজনীতি থাকত৷ সেসময় রাজনীতি সম্পর্কে তেমন কিছু বুঝতাম না, ধারনাও ছিল না৷ তাই তাদের গল্পগুজবের আশেপাশে আমরা থাকতাম না৷ আমরা ছোটরা বরং দলবেধে মাঠের মাঝখানে নানা ধরনের খেলা খেলতাম৷
তবে সবসময় অবশ্য এই সুযোগ হতো না। বেশিরভাগ সময়েই হারিকেন কিংবা মোমবাতির আলোয় পড়ার টেবিলে বই সামনে নিয়ে বসে থাকতে হতো৷ প্রচন্ড গরম, তার উপর আবার মশার উৎপাত! এই অবস্থায় কি পড়ায় মন বসানো যায়? একদমই না৷ কিন্তু কিছুই করার ছিল না। বই সামনে নিয়েই বসে থাকতে হতো৷
হারিকেন কিংবা তেলের কুপি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে মোমবাতির চল এখনোও আছে। আশে পাশের ২-১ টা দোকানে খুঁজলেই হয়তো মোমবাতি পাওয়া যেতে পারে। তবে শেষের দিকে আমাদের বাসায় জেনারেটরের লাইন নেয়া হয়েছিল, তাও শুধুমাত্র একটা লাইটের জন্য৷ প্রতিদিন ৫ টাকা করে মাসে ১৫০ টাকা। সেসময় জেনারেটরের বিজনেসও অনেক লাভজনক একটা বিজনেস ছিল৷ কালের পরিক্রমায় এখন সেই জেনারেটরের বিজনেসও হারিয়ে গিয়েছে৷
কলেজে যখন পড়তাম, তখন লোডশেডিং এর সময়গুলোতে হোস্টেলের ছাদে চলে যেতাম। শুক্রবারে সবাই মিলে বসে ভূত এফএম শুনতাম। অন্যান্য দিনগুলোতে আড্ডা দিতাম কিংবা গান গাইতাম৷ গরমের সময়ে লোডশেডিং হলে হোস্টেলের সবাই ছাদে চলে যেতাম৷ পুরো হোস্টেলজুড়ে একটা উৎসব উৎসব আমেজ বিরাজ করতো৷
গ্রামে গিয়ে লোডশেডিং পাল্লায় পড়ে খানিকটা বিরক্ত লাগলেও পুরানো স্মৃতিগুলো একটু একটু করে মনে পড়তে লাগল। একসময় প্রতিদিন ১০-১২ ঘন্টা লোডশেডিং সহ্য করা আমরা এখন ৩-৪ ঘন্টার লোডশেডিং সহ্য করতে পারি না। সময়ের সাথে সাথে মানুষের অনেক পরিবর্তন আসে৷ এটাও হয়তো এরকমই একটা পরিবর্তন৷