রুপান্তর

সবসময় জীবনের চিত্রটা বোধহয় একরকম দেখতে হয় না, যে দৃশ্য আমরা আগে থেকেই ধরে নেই যে তার রুপ, আকার অবস্থা এমনটি হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এসে দেখা যায় তার থেকে বরং কিছুটা আলাদা দেখতে। সময় আসে যখন যেকোন একটি দিক বেছে নিতে হয়, সংকট কিংবা শাঁখের করাত, যে নামেই ডাকা হোক না কেন - মন কি চায়, বাস্তবতা কি দাবি রাখে, তার মধ্য থেকে যেকোন একটি, দুটি নয়। এমন সমীকরণের সন্ধিক্ষণে এসে ফুটে উঠে চমৎকার এক গল্প, নিগূঢ় রূপসীরেখা,মনোহর আখ্যান -যার রুপান্তর সহজভাবে কঠিন।

ঐশ্বর্য, সম্মান, যশ, খ্যাতি, বিত্তবৈভবের সবচেয়ে উঁচু লেবাসে থেকে কি সবসময়ই একটি জীবনের মধুমাখা রূপটি ধরে দেখা যায়, অনুভব করা যায় তার মায়া? জটিল নিয়মের বাঁধা জীবন একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচে থেকে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়িয়ে স্বাদ নেয়ার তৃপ্তিবোধে আকুল হয়ে ওঠে। সুখের সন্ধান সবাই হয়তো একভাবে করে না, বাঁচার আনন্দের পছন্দ কেমন হতে পারে, তার বৈচিত্র এত বেশি যে তার পূর্ণাঙ্গ স্বরুপ দেখানো কঠিন। কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন নিজেকে মাঝে মাঝে করেছি, তার গুটিকতকের উত্তর পেয়েছি,কিছুর পাইনি। তবে একসময় এসে যেন মনে হয়েছে- তার উদাহরন ছড়িয়ে আছে দূরের কোন এক শহরে,একটি ছোট পরিবারের মাঝে।

Source

ঝলমলে আলোর রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, সাদা বক উড়ে যাচ্ছে লেকের পাশ দিয়ে, আয়নার মতো স্বচ্ছ পথে মানুষের আনাগোনা, নতুন দিনের সকালের উঠতি সৌন্দর্যে মন সহজেই হারিয়ে যেতে চাইবে৷ শহরটিতে মানুষগুলো চরিত্রের উত্তম দিকগুলোর বিকাশ ঘটিয়েছে, জীবনবোধে যেন কোন কালিমা নেই, অন্ধকার নেই, কখনো কারো অনিষ্ট সাধনের চিন্তা মাথায় এসে ভীড় করে না ; আগন্তুক অপরিচিতের সাথেও হাসিমাখা ব্যবহার,আন্তরিকতায় ঢাকা একটি মিষ্টি মুখ থেকে যেন সৌজন্য ভেসে ওঠে।

এমন শহরে জন্মলাভ করেছে একটি মেয়ে, শৈশবে বাবার কোল ধরে স্কুলে বড় হওয়া, একক পরিবারের মধ্যে থেকে সংসার আর প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য দেখে শেখা, মধ্যবিত্ত একটি গোছানো সুখের পরিবারের সবটুকু গুন, চারিত্রিক মাধুর্যতা পেয়ে বেড়ে উঠেছে নবযৌবনের শুভেচ্ছার অলঙ্কারের মতো৷ এমন এক জীবন পরিসরের মধ্যে থেকে নিজের ভবিষ্যতকে গড়ে তোলার সময় এলো যখন কলেজ জীবনের প্রবেশে দিন কাটতে লাগলো। কখনো পড়াশোনায়, পার্কে ভ্রমন পায়চারী, থিয়েটারের মঞ্চ, আর্ট গ্যালারীর আঙিনায় ঘুরে আসা কিংবা আপন মনে লেকের পাড়ে বসে প্রকৃতি উপভোগ, এই ছিল নিত্যকার জীবনের রূপ।

বেশ ভালোই কাটছিল সময়,কোন টানাপোড়েন নেই, নেই কোন পিছুটান, দুশ্চিন্তার কপালের ভাঁজে এলোমেলো রেখা সহজে ভেসে ওঠে না। ছোট পরিবারের মধ্যে থেকে চাওয়া পাওয়ার গন্ডি এতো ছোট হতে পারে,ভেবেই হারিয়ে যেতে হয় বিস্মৃতিপ্রবন হয়ে। তবে কিছু না কিছু প্রত্যাশা মেয়েটির জীবনেও ছিল, কেননা এ এমন এক বিষয় যেটি ছাড়া জীবনের অর্থ অদৃশ্যতর হয়ে পড়ে, ভবিষ্যতের পথ অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একাকী জীবনে খুঁজে ওঠা কোন একটি অবলম্বন যেটি ধরে অনেকদূর পাড়ি দেয়া যায়। মানুষ যা চায়, তার কিছু না কিছুর সন্ধান পেয়ে যায় - এটি দৈবভাবে ঘটে।

Source

অলস দুপুরে সবাই যখন নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত, তখন মেয়েটি ব্যালকনিতে বসে একমনে ছবি আঁকায় ব্যস্ত। তুলির আঁচড়ে উঠে আসছিল শ্যামল হলুদ পাতার রং, বালিহাসের ঝোপঝাড়ের লেকের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য, পাখির পাখা ঝাপটানোর গতিময় চিত্ররূপ। ছবিটি আঁকা শেষ হলো, এমন সময় পিছনে ফিরে সে দেখলো দাঁড়িয়ে আছে এক মূর্তির মতো বিস্ময়ে তাকানো একটি মুখ, আভিজাত্যে ঢাকা, ব্যাক্তিত্বে গড়া একটি মধ্যবয়সী যুবক। ঠিক যেমন কোন এক কল্পনায় মিশে থাকা মুখচ্ছবি, সুশ্রী - প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত একটি ব্যাক্তি।

প্রাথমিক কিছু স্বভাবসুলভ সঙ্কোচ মেয়েটিকে ঘিরে ধরলেও সময়ের সাথে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে স্থায়ী একটা বন্ধনে, যেটা বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে শুরু করে। মেয়েটির সারল্য, হাসিখুশি মুখশ্রী, জীবন সম্পর্কে সুন্দর জ্ঞান মুগ্ধ করে রেখেছিল তাকে। সে নিজের উচ্চ পারিবারিক জীবনে যা এতদিন দেখে এসেছে, মাঝে মাঝে হালকাভাবে দম নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে, এমন মানুষের সাথে কিছু সময় কাটাতে চেয়েছে, যে জীবনের মধুর সুন্দর, পবিত্র, গরীয়ান একটি রূপ দেখাবে -যার অপেক্ষায় অনেকদিন পার করে দিয়েছে৷

নিয়মের বেড়াজালে আর আনুষ্ঠানিকতায় মোড়ানো অট্টালিকার প্রাসাদে, গল্ফ খেলা আর অতিথি ভোজের নিমন্ত্রণ, অভ্যর্থনা আদায় বিদায় তার কাছে কৃত্রিম মনে হতো। এতদিন পর দেখা পেলো এক জীবনের রূপের যার মোহে সে সারাবেলা মুগ্ধ হয়ে কাটাতো। মেয়েটির সাথে একটি দীর্ঘস্থায়ী জীবনে প্রবেশ করার উপায় ছিল একটি, তার সেই বিশাল ঐশ্বর্য ত্যাগ করতে হবে,একটি সিদ্ধান্ত, একটি পছন্দ, দুটির মধ্যে একটি, বেছে নেওয়ার সময়ে সংকটে উত্তরন করে জীবনে নতুন পর্ব শুরু - এই ছিল খোলা পথ।

সে খুঁজে পেল তার নতুন গন্তব্যে যাওয়ার পথসঙ্গীকে, যার মনটি আঁকা ছবির মতো সুন্দর, যে ছোট পরিবারের মাঝে বড় হয়ে এক বিশাল জগৎ গড়ে নিয়েছে, সর্বোপরি তাকে এমন পথ দেখিয়েছে যেখানে সুধাময়ী পানীয় রয়েছে, তৃষ্ণার্ত পথিক নদীর ধূ ধূ জলরাশি দেখা পেলে উদগ্রীব যেমন করে হয়, তেমনি করে নতুন একটি পথ দেখতে পেলো।
শেষকালে মেয়েটির মতো সাধারন একটি জীবনে চলে আসা, সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে সেই আয়নার মতে শহরে যেখানে কল্পনারা ছুটে যায়, তার মতো করে বাঁচতে মিশে গেল।

Source

এভাবে বেঁচে থাকাতে সে হয়তো আড়ম্বর হারালো কিন্তু খুৃঁজে পেল তার মনের মতো জীবন, যেটি শান্ত সাবলীল, সহজ, প্রাকৃতিক নির্ঝঞ্ঝাট, সরস মুখর স্বাধীন এক রূপসী সময়ের সন্ধান। বসন্তের দিনেরা বয়ে যেতে যেতে মিশে গেল বিস্মৃতির বারান্দায়, দীপ নিভলো, গল্প ফুরালো।

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
1 Comment
Ecency